রাসায়নিকের গুদাম পুরান ঢাকায় আর রাখা যাবে না

>

পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী রাসায়নিক গুদাম। ঘিঞ্জি এলাকা ও সরু সড়কের কারণেও পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। পাশের মৌলভীবাজার পাইকারি বাজারও রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে। এসব বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. গোলাম মাওলা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার।

মো. গোলাম মাওলা, সাধারণ সম্পাদক, মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতি
মো. গোলাম মাওলা, সাধারণ সম্পাদক, মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতি

প্রথম আলো: রাসায়নিক গুদামের কারণে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অনেকেই বলছেন, নিমতলীর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকা থেকে গুদামগুলো সরানো গেলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। আপনার মতামত কী?

গোলাম মাওলা: মৌলভীবাজার ও চকবাজারে কেমিক্যাল, প্রসাধনী, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ব্যবসা রয়েছে। এসব ব্যবসা তো আর এক দিনে গড়ে ওঠেনি। যুগ যুগ ধরে এসব ব্যবসা গড়ে উঠেছে। পুরান ঢাকার শুধু চকবাজার না, কোতোয়ালি, লালবাগ, গেন্ডারিয়া এলাকায় ছোট ছোট কারখানা আছে। বংশালে জুতার কারখানায় ব্যবহারের জন্য সলিউশনের (আঠা) গুদাম আছে, যা কিনা সবচেয়ে দাহ্য রাসায়নিক। অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা ঘটে গেছে। এ ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরাই। দাহ্য রাসায়নিক সরানোর একটি পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয়ের গড়িমসির কারণে চকবাজারের ঘটনা ঘটেছে। কেউ কারও দোষ স্বীকার না করে এখন এসে ঢালাওভাবে ব্যবসায়ীদের ওপর দায় চাপানো হচ্ছে। এটির সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র রাসায়নিকের গুদাম সরানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেটির সঙ্গে আমরা একমত। দাহ্য রাসায়নিকের গুদাম পুরান ঢাকায় আর রাখা যাবে না। তবে গুদাম সরাতে গিয়ে যাতে কোনো ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত না হন, কারও ওপর যাতে জুলুম করা না হয়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

প্রথম আলো: পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম ৯ বছরেও কেন সরানো গেল না? কারা দায়ী?

গোলাম মাওলা: বর্তমান সরকার অত্যন্ত শক্তিশালী সরকার। ব্যবসাবান্ধব সরকার। সরকার যদি কোনো নির্দেশনা দেয়, তাহলে ব্যবসায়ীরা মানবেন না, তা কোনোভাবেই হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক ছিলেন। তবে সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বেশি ক্ষতি করে গেছেন। তারপর শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আমির হোসেন আমু। এখন আমরা গণমাধ্যমে দেখছি, সাবেক দুই শিল্পমন্ত্রী রাসায়নিকের গুদাম সরানো নিয়ে একে অন্যকে দোষ দিচ্ছেন। তবে কাদা ছোড়াছুড়ি না করে একে অন্যকে দোষ না দিয়ে ভবিষ্যতে যাতে স্থায়ী সমাধান হয়, সে জন্য কাজ করা দরকার। কোনো ঘটনা ঘটলে সবাই তৎপর হন। কিছুদিন পর সবকিছু হিমাগারে চলে যায়। রাসায়নিকের গুদাম কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের লাল ফিতার দৌরাত্ম্যের মধ্যে থাকলে আগামী ৯ বছরেও সেটি বাস্তবায়িত হবে না।

প্রথম আলো: মৌলভীবাজার ও চকবাজারে নকল পণ্য বিক্রি হয়। বিশেষ করে প্রসাধনী। সে জন্য আশপাশের এলাকায় অনেক ভবনে কারখানা গড়ে উঠেছে। সেসব কারখানা নানাভাবে ঝুঁকি তৈরি করছে। আপনারা কী করছেন?

গোলাম মাওলা: সৎ ও অসৎ ব্যবসায়ী সব জায়গাতেই আছেন। আমাদের মৌলভীবাজারে ব্যবসায়ী সমিতি কখনো কোনো অনৈতিক কাজকে সমর্থন দেয় না। সমিতির পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে—নকল ও ভেজাল পণ্য বিক্রি করা যাবে না। চকবাজার-মৌলভীবাজার বিরাট মার্কেট। বেশ কয়েক হাজার দোকান। সব দোকান তো আমাদের পক্ষে চেক দেওয়া সম্ভব না। তবে নকল ও ভেজালের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালালে আমরা সব সময় তাদের পাশে থাকব।

প্রথম আলো: পুরান ঢাকাকে নিরাপদ করতে হলে রাসায়নিক গুদাম সরানোর পাশাপাশি আরও কী করা দরকার?

গোলাম মাওলা: সব ব্যর্থতা ব্যবসায়ী ও পুরান ঢাকাবাসীর ওপর চাপালে হবে না। পুরান ঢাকার সব এলাকাতেই নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে। চুলার পাশেই গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হচ্ছে। চুলার তাপেই যেকোনো সময় বিস্ফোরণ হতে পারে। এসব বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া বিশ্বের অনেক দেশেই অলিগলিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট আছে। পাশের দেশ ভারতের পুরোনো শহর কলকাতায় এমন ব্যবস্থা আছে ব্রিটিশ আমল থেকে। আমাদের দেশে গুলশান, বনানী ও উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাতেও ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই। এটি বাস্তবায়নে এমন কোনো মহাপরিকল্পনার দরকার নেই। আমাদের যে পানির লাইন আছে, সেখান থেকেই পাইপ দিয়ে ফায়ার হাইড্রেন্ট করা যায়। কোনো ঘটনা ঘটলে আমাদের মাথায় অনেক পরিকল্পনা আসে। কিন্তু আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে এসেও পানি খুঁজতে খুঁজতে সময় চলে যায়। এর মধ্যে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পুরান ঢাকায় এমন কিছু অলিগলি আছে, যেখান দিয়ে মৃত্যুর পর লাশ বের করার জায়গা নেই। ওপর থেকে রশি দিয়ে বেঁধে নামাতে হয়। অনেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লট আছে। সেগুলোকে একত্র করে পরিকল্পিত নগরায়ণ দরকার। আবার অলিগলিতে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির অফিস রয়েছে। প্রতি রাতে যখন কোম্পানিগুলোর কাভার্ড ভ্যান ঢোকে, তখন পুরো সড়ক ব্লক হয়ে যায়। দাহ্য রাসায়নিকের সঙ্গে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির অফিসও সরিয়ে নিতে হবে। এগুলো পুরান ঢাকার জন্য বিষফোড়া। ধাপে ধাপে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। একসঙ্গে করতে গেলে কিন্তু জগাখিচুড়ি হয়ে যাবে।