বিলেট উৎপাদনে স্বনির্ভর বাংলাদেশ!

বিলেট উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বনির্ভর। এতে রড উৎপাদনের খরচ কমেছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কেএসআরএম কারখানায় বিপুল পরিমাণে বিলেট উৎপাদিত হয়। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। কেএসআরএমের সৌজন্যে
বিলেট উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বনির্ভর। এতে রড উৎপাদনের খরচ কমেছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কেএসআরএম কারখানায় বিপুল পরিমাণে বিলেট উৎপাদিত হয়। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। কেএসআরএমের সৌজন্যে
>
  • ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিলেট আমদানি হয়েছিল প্রায় ১৭ লাখ টন
  • চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে তা নেমে এসেছে ২০ হাজার টনে

রড উৎপাদনের মধ্যবর্তী কাঁচামাল হলো বিলেট। এই বিলেট উত্তপ্ত করে ছাঁচে ফেলে রড তৈরি করা হয়। কয়েক বছর আগেও রড তৈরির কারখানাগুলোয় চাহিদা অনুযায়ী বিলেট তৈরি হতো না। ফলে বেশির ভাগ কারখানাই বিলেট আমদানি করে রড উৎপাদন করত। তাতে খরচও বেশি পড়ত। আবার বিদ্যুৎ-সংকটের কারণে সক্ষমতা অনুযায়ী বিলেট উৎপাদনে ধারাবাহিকতা রাখা যেত না। বিদ্যুৎ-সংকট কেটে যাওয়ায় এবং সরকারি নীতির কারণে এই খাতে নতুন নতুন কারখানা গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তারা। এতে ধীরে ধীরে পাল্টে গেছে বিলেট আমদানির চিত্রও।

এখন রড ও রডজাতীয় পণ্য তৈরির কারখানাগুলো নিজেরাই পুরোনো লোহা গলিয়ে বিলেট উৎপাদন করছে। নতুন নতুন বিনিয়োগে কারখানা স্থাপন করেছে। এতে বিলেট আমদানি কমে স্বনির্ভর হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। প্রাথমিক কাঁচামাল থেকে রড তৈরি হওয়ায় মূল্য সংযোজনও বেশি হচ্ছে।

বিলেট আমদানি হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এই বন্দরের তথ্যে দেখা যায়, চার অর্থবছর ধরে বিলেট আমদানি ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিলেট আমদানি হয়েছিল ১৬ লাখ ৯৬ হাজার টন। চাহিদা বাড়লেও পরের বছর তা কমে দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৭২ হাজার টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমদানি হয় ৩ লাখ ৮২ হাজার টন। গত অর্থবছরে আমদানি নেমে আসে ১ লাখ ৬৫ হাজার টনে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) আমদানি হয়েছে মাত্র ২০ হাজার টন। এ হিসেবে চলতি অর্থবছর শেষে বিলেট আমদানির পরিমাণ অর্ধলাখে নেমে আসবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. সেলিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, বিলেট উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার অর্থ হলো ইস্পাত পণ্য তৈরিতে একটি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পে বাংলাদেশ এখন স্বনির্ভর। এতে যে মূল্য সংযোজন হচ্ছে, তাতে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। আবার এই মূল্য সংযোজনের অর্থ শ্রমিকদের মজুরি, মালিকের মুনাফা এবং সরকারের রাজস্ব খাতেও যাচ্ছে। এভাবেই একদিন বাংলাদেশ মৌলিক ইস্পাতশিল্পের দিকে ধাবিত হবে। আকরিক ও কয়লা থেকে ইস্পাতের হাজারো পণ্য তৈরির যে সম্ভাবনা রয়েছে এ দেশে, তা দেশীয় উদ্যোক্তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশে সূচনা হবে বলে তাঁর আশা।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে ইস্পাত পণ্য উৎপাদনের মৌলিক কারখানা নেই। মৌলিক কারখানায় আকরিক লৌহ, কয়লা, চুনাপাথর ও সামান্য পরিমাণ পুরোনো লোহার টুকরো কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব কাঁচামাল ব্যবহার করে লং স্টিল হিসেবে পরিচিত রড, চ্যানেল, অ্যাঙ্গেল এবং ফ্ল্যাট স্টিল হিসেবে পরিচিত ঢেউটিন, ইস্পাত পাত, পাইপসহ বহু ধরনের পণ্য তৈরি করা যায়।

বিলেট আমদানি ৪৪ থেকে ১ শতাংশে

আমদানি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিলেটের চাহিদা ছিল ৩৮ লাখ টন। এই চাহিদার প্রায় ৪৪ শতাংশই ওই অর্থবছর আমদানি করতে হয়েছে। বাকি ৫৬ শতাংশ বা ২১ লাখ টনের মধ্যে ছিল দেশে তৈরি বিলেট ও জাহাজভাঙা শিল্পের লোহার প্লেট। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিলেটের চাহিদা ছিল ৪৬ লাখ টন। এর মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ বা ১ লাখ ৬৫ হাজার টন আমদানি করতে হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে বিলেটের চাহিদা ছিল ৩০ লাখ ৬৪ হাজার টন। এই চাহিদার ১ শতাংশের কম বা মাত্র দশমিক ৭ শতাংশ আমদানি করতে হয়েছে। তবে বিলেটের পরিবর্তে বিলেট তৈরির কাঁচামাল পুরোনো লোহার টুকরো ও পুরোনো জাহাজ আমদানি বেড়েছে। প্রতিবছর পুরোনো লোহার টুকরো আমদানি বেড়ে চলেছে।

কাস্টমসের তথ্য পর্যালোচনায় বাংলাদেশে বিলেট আমদানির সর্বশেষ তালিকায় পাওয়া গেছে দুটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের নাম। এ দুটি হলো বিএসআরএম এবং কেএসআরএম গ্রুপ। গত অর্থবছর বিএসআরএম গ্রুপ প্রায় ৭৮ হাজার টন এবং কেএসআরএম গ্রুপ ৮৭ হাজার টন বিলেট আমদানি করে। এখন এই প্রতিষ্ঠান দুটি নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী বিলেট তৈরিতে প্রায় সক্ষমতা অর্জন করেছে।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) মহাসচিব ও মেট্রোসেম ইস্পাত লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ বছর আগেও চাহিদার ৬০ শতাংশ বিলেট আমদানি করতে হতো। দেশে উৎপাদিত হতো ৪০ শতাংশ। এখন আমদানির পরিমাণ খুবই কম। তিন বছর আগে বিলেট আমদানিতে শুল্কহার বাড়ানোর সরকারি নীতি বাস্তবায়নের কারণে এ খাতে নতুন নতুন কারখানা গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তারা। এতে বিলেট উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এতে দেশীয় এ শিল্পে মূল্য সংযোজনের হার বেড়েছে। বেসরকারি খাতের এই বিনিয়োগে সুরক্ষা দিতে হলে সরকারি নীতি পরিবর্তন করা উচিত হবে না।

বিলেট কারখানায় প্রচুর বিদ্যুৎ খরচ হয়। বিদ্যুৎ-সংকট থাকলে এ ধরনের কারখানায় উৎপাদনে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় না। এ জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার দাবি এ খাতের উদ্যোক্তাদের।

দেশীয় কারখানার সক্ষমতা শতভাগ

বাংলাদেশে একসময় বিলেট তৈরি হতো চিটাগাং স্টিল মিলসে। সরকারি এই কারখানায় বিলেট, ইনগট ও ঢেউটিন তৈরির পাত উৎপাদিত হতো। সরকারি এই কারখানা বন্ধ হওয়ার দুই বছর আগে ১৯৯৬ সালে দেশের বিলেট তৈরির সবচেয়ে বড় কারখানা গড়ে তোলে বিএসআরএম গ্রুপ। ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত বিএসআরএম গ্রুপটির বিলেট উৎপাদনক্ষমতা ছিল দেড় লাখ টন। ২০১০ ও ২০১৬ সালে গ্রুপটির উৎপাদনক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ লাখ টনে। গত সপ্তাহে গ্রুপটির নতুন আরেকটি কারখানায় পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে। ফলে এই গ্রুপের বার্ষিক বিলেট উৎপাদনক্ষমতা উন্নীত হচ্ছে ১৮ লাখ টনে। ফলে তাদের আর বিলেট আমদানি করতে হবে না।

বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আলীহোসেইন আকবরআলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিলেট আমদানিতে শুল্ক-কর বাড়ানোর যে নীতি সরকার নিয়েছে, সে কারণেই দেশে বিলেট কারখানা গড়ে তুলেছি। চাহিদ অনুযায়ী বিলেট উৎপাদনে সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। বিলেট উৎপাদন খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগও হয়েছে।’

বাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা আবুল খায়ের গ্রুপও বিলেট তৈরিতে স্বয়ংসম্পন্ন। বেসরকারি ওয়ান ব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়, আবুল খায়ের গ্রুপের বার্ষিক রড উৎপাদনক্ষমতা ১২ লাখ টন। কোম্পানিটির বিলেট উৎপাদনক্ষমতাও একই পরিমাণ। ফলে তাদেরও বিলেট আমদানি করতে হচ্ছে না।

বাজারে তৃতীয় অবস্থানে থাকা কেএসআরএম গ্রুপের রড উৎপাদনক্ষমতা ৮ লাখ টন। ২০১৪ সালে তারা বিলেট উৎপাদনক্ষমতা বাড়িয়ে ৬ লাখ টনে উন্নীত করে। এখন তা ৮ লাখ টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে তাদের।

জিপিএইচ গ্রুপ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সীতাকুণ্ডে যে কারখানা গড়ে তুলছে, তাতে বিলেট ব্যবহারের দরকারই হবে না। বার্ষিক ৮ লাখ ১৫ হাজার টন উৎপাদনক্ষমতার কারখানাটিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুরোনো লোহা থেকে বিলেট তৈরি হয়ে সরাসরি রড ও রডজাতীয় পণ্য তৈরি হবে। এ বছরের মাঝামাঝি উৎপাদন শুরু হবে কারখানাটির।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে বর্তমানে দেশে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির রড তৈরির ৪৪টি কারখানা রয়েছে। আর সনাতন পদ্ধতির ছোট আকারের কারখানা রয়েছে ১০০টির মতো। সব কারখানা মিলিয়ে বার্ষিক রড, চ্যানেল, অ্যাঙ্গেলসহ লং স্টিল পণ্য উৎপাদন সক্ষমতা ৮০ লাখ টন। আর উৎপাদিত হচ্ছে ৫৫ লাখ টন।