সরকারি ব্যাংক কতটা প্রয়োজন?

চিমিয়াও ফান। সম্প্রতি িবশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
চিমিয়াও ফান। সম্প্রতি িবশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো
>

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান তিন বছর দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। যাওয়ার আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি কথা বলেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ, ব্যাংক খাত, দুর্নীতি, সুশাসন, বৈষম্য আর তাঁর সবচেয়ে অপছন্দের যানজট বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাহাঙ্গীর শাহ।

প্রথম আলো: তিন বছর ধরে দায়িত্ব পালনের সময় আপনি বাংলাদেশের কী ধরনের পরিবর্তন ও চ্যালেঞ্জ দেখেছেন?

চিমিয়াও ফান: বাংলাদেশে আমার অভিজ্ঞতা চমৎকার। নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে উন্নয়ন ঘটে। বিশেষ করে গত দুই দশকে বাংলাদেশে গর্ব করার মতো অগ্রগতি হয়েছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। এটি খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। মানব উন্নয়নে বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক খাতে দেশটি বেশ এগিয়েছে। তবে শিশুর খর্বাকৃতি এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এ দেশের এক-তৃতীয়াংশ শিশু এখনো খর্বাকৃতির। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে নতুন চ্যালেঞ্জ এখন মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এত অসুবিধার মধ্যেও বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ।

নানা অগ্রগতি সত্ত্বেও আমি মনে করি, বাংলাদেশের সামনে বেশ কিছু উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব খুব বেশি। এখানে অল্প জায়গায় সাড়ে ১৬ কোটি লোকের বসবাস। যদি যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক মানুষকে লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যে রাখা হয়, তাহলে তা বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বের সমান হবে। তা সত্ত্বেও এত লোকের খাবারের জোগান দিতে পারছে বাংলাদেশ। এটি বিশেষ একটি (মিরাকল বা অলৌকিক) ব্যাপার।

দ্বিতীয়ত, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচনের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সঠিক পথে আছে। এ দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর নয়, খুবই শক্ত ভিত্তির ওপরে আছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধিও স্থিতিশীল। গত দশকে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়েছে, আমি নিশ্চিত, সঠিক নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আরও দ্রুত বাড়াতে পারবে। সামগ্রিকভাবে অবকাঠামোর ঘাটতি দ্রুত প্রবৃদ্ধির পথে একটি বড় বাধা। এর পাশাপাশি দ্রুত নগরায়ণের কারণে নাগরিক সেবা প্রদানও বড় চ্যালেঞ্জ।

তৃতীয়ত, নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণে সংগতিপূর্ণ নীতি দরকার। যেমন বেসরকারি বিনিয়োগ দ্রুত বাড়াতে হবে। নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় সেবা প্রদানের কার্যকারিতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। চতুর্থত, মানবসম্পদ উন্নয়নে আরও বিনিয়োগ চাই। শিক্ষার মান বৃদ্ধি করা খুব জরুরি, যাতে দক্ষ শ্রমশক্তি তৈরি হয়। বিশ্বজুড়েই প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। শ্রমশক্তিতে সেই প্রযুক্তি ধারণ করার মতো জনবল তৈরি করতে হবে, যাতে শ্রমবাজারের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে দেশটি তাল মেলাতে পারে। পঞ্চমত, জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়টিও গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রথম আলো: এ দেশের ব্যাংক খাত অর্থনীতির অন্যতম দুর্বল খাত। এই খাতের সংস্কারে কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

চিমিয়াও ফান: আর্থিক খাতে বেশ কিছু মৌলিক ইস্যু আছে। প্রথম ইস্যু হলো, এই খাতের কাঠামোগত ধরন। বাংলাদেশের আর্থিক খাত মূলত ব্যাংকনির্ভর। নামমাত্র কিছু ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে। তাই ব্যাংক খাতের সংস্কারের পাশাপাশি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য কী ধরনের নীতি প্রয়োজন তা দেখতে হবে, কীভাবে ব্যাংক খাতকে আরও কার্যকর করা যায়, তা চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে আর্থিক খাতে রাষ্ট্রের মালিকানাকে কীভাবে দেখা হবে, সে বিষয়ে পর্যালোচনার সময় এখন। যেমন রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক বাংলাদেশে কতটা প্রয়োজন, এসব ব্যাংকের কার্যক্রম কী উদ্দেশ্য পূরণ করছে, তা পর্যালোচনা করা দরকার। বর্তমানে যেসব ব্যাংক রয়েছে তার বেশির ভাগই বাণিজ্যিক ব্যাংক; এগুলো উন্নয়ন ব্যাংক নয়। এসব ব্যাংক পুঁজি জমার রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়। তাই ব্যাংকগুলোর কী ভূমিকা হওয়া উচিত, তা ঠিক করা দরকার। এ ছাড়া রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠাও জরুরি।

ব্যাংক খাতের আরেক সমস্যা হলো, খেলাপি ঋণ। করপোরেট সুশাসনের অভাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এই পরিস্থিতির উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংককে কার্যকর নীতি নিতে হবে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ নিয়ে কিছু আইনি বিষয়ও আছে। অনেক লোক টাকা নিয়ে পরিশোধ করছেন না, কিন্তু তাঁরা আদালতে গিয়ে খেলাপি ঋণের ঘোষণা থেকে বিরত থাকার আবেদন করতে পারেন। এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা দরকার।

প্রথম আলো: বেশ কয়েক বছর আগে ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন কী ধরনের সংস্কার দরকার?

চিমিয়াও ফান: এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। মূলত রাষ্ট্রের সহায়কের ভূমিকার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিযোগিতামূলক করতে পরিবেশ তৈরি করতে হবে, ব্যবসায় ঝুঁকি কমাতে হবে। এ ক্ষেত্রে আর্থিক খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও বাংলাদেশের রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে রাষ্ট্রের মালিকানার বিষয়টিও দেখতে হবে। এটি (রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক) নিয়ে কার্যকর উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। এই বিষয়ের সুরাহা হলে অন্য প্রশ্নের জবাব সহজ হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় বৈচিত্র্য আনতে হবে। এটি করপোরেটাইটেজশন বা বেসরকারীকরণের মাধ্যমে হতে পারে। এ ছাড়া কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে পরিচালিত হলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা যেতে পারে, যা ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় বৈচিত্র্য আনবে।

প্রথম আলো: এ দেশে দুর্নীতি বড় ইস্যু। সরকার বলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আপনার সুপারিশ কী?

চিমিয়াও ফান: দুর্নীতি বিষয়টি খুবই জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো দেশের জন্যই এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কয়েকটি দিক থেকে এই বিষয় চিন্তা করতে হবে। প্রথমত, কীভাবে দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ করা যায়, তা খুঁজে বের করা। ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়মকানুন সহজ করার পাশাপাশি স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে। কর্মকর্তা ও সুবিধাভোগীর মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেক সময় কর্মকর্তাদের ইচ্ছামাফিক কিছু করার সুযোগ থাকে, যা দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে দুর্নীতির উৎসকে বন্ধ করা যাবে। একই সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন ধাপে কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের মত খুবই স্পষ্ট। আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে বিশ্বব্যাংকের দেওয়া প্রতিটি ডলার, প্রতিটি সেন্টের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে এবং যে কাজে দেওয়া হচ্ছে, সে কাজেই ব্যবহৃত হচ্ছে।

আমি মনে করি, দুর্নীতি রোধে আধুনিক প্রযুক্তি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন অনলাইন ব্যবস্থায় সরকারি কোষাগার থেকে সরাসরি রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগীর ব্যাংক হিসাবে টাকা চলে যাবে। এতে সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সুবিধাভোগীর হাতে নগদ টাকা লেনদেনের সুযোগ থাকবে না। এতে দুর্নীতি কমে যাবে।

প্রথম আলো: একটি বিষয় নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, গণতন্ত্র আগে নাকি উন্নয়ন আগে? আপনি কি মনে করেন, এই দুটির মধ্যে ঐকমত্য আছে, নাকি বৈপরীত্য আছে?

চিমিয়াও ফান: প্রতিটি দেশই আলাদা, প্রতিটি দেশকেই নিজস্ব উন্নয়ন কৌশল ও পথপরিক্রমা ঠিক করতে হয়। তবে আমি মনে করি, দারিদ্র্য বিমোচন ও সমৃদ্ধির ভাগাভাগি—এই দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। উন্নয়নের সুবিধা অবশ্যই ন্যায়সংগত হতে হবে। এই সুবিধা সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে, যাতে সবাই অনুভব করেন, তাঁরা উপকৃত হচ্ছেন।

প্রথম আলো: দুই-তিন বছর ধরে বিশ্বব্যাংকের ব্যবসায় সহজ করার সূচকে বাংলাদেশ প্রায় একই স্থানে আছে। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কী করা উচিত?

চিমিয়াও ফান: ব্যবসায় সহজ করার সূচকে একটি দেশ কতটা এগোল, তা জানতে শুধু নিজের সঙ্গে তুলনা করে নয়; প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো কতটা এগিয়েছে সেটাও বিবেচনা করতে হবে। একটি দেশ ভাবতে পারে, নিজেরা অনেক সংস্কার করেছে অথচ র‌্যাঙ্কিংয়ে তেমন উন্নতি হয়নি। সেটি হয় কারণ, অন্য দেশগুলো অনেক বেশি সংস্কার করেছে। বিশ্বব্যাংকের ব্যবসায় সহজ করার প্রতিবেদনে কিছু আইনি সংস্কারের সূচক আছে। দেখা গেল, আইন তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। তাতেও অবস্থার উন্নতি হয় না।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে। আবার স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য নমনীয় শর্তের ঋণ পাওয়া কঠিন হবে। বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?

চিমিয়াও ফান: শুধু বাংলাদেশ নয়, যেকোনো দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেলে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। সহজ ভাষায় বলা চলে, সাফল্যের মূল্য (কস্ট অব সাকসেস) রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক থেকে আরও কয়েক বছর সহজ শর্তে ঋণ নিতে পারবে। অন্যদিকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণকালীন সময়ে বাংলাদেশকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের দিকে বেশি জোর দিতে হবে।

প্রথম আলো: আপনি গত তিন বছর দায়িত্ব পালন করে ফিরে যাচ্ছেন। এই সময়ে এ দেশে আপনার সবচেয়ে ভালো লেগেছে কী? আর সবচেয়ে অস্বস্তিকর বিষয় কী ছিল?

চিমিয়াও ফান: আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবান যে আমি আমার কাজের মাধ্যমে অন্যকে সাহায্য করার মতো কাজ করতে পারছি। ঢাকায় থাকাকালে প্রতিদিনই হয় সরকারি, না হয় বেসরকারি খাতের লোকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে এসব আলাপ-আলোচনা আমাকে এই দেশের সমস্যা, চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করতে সহায়তা করেছে। এরপর সমাধানের পথও চিন্তা করা গেছে। এই বিষয়গুলো আমি ‘মিস’ করব। আর অস্বস্তিকর বিষয় ছিল ঢাকার যানজট। এখানকার মানুষ অনেক সময় ট্রাফিক আইন মানতে চান না, তাঁদের এই আচরণ পরিবর্তন করা উচিত। ঢাকার যানজট নিরসন ও উন্নয়নের জন্য শুধু পরিকল্পনা করলেই হবে না, বাস্তবায়নও করতে হবে। এ জন্য একটি সামগ্রিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার।