জিডিপির প্রবৃদ্ধি হলেই সুখ মেলে না

অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে প্রায় সব দার্শনিকই বলেছেন, টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না। তবে টাকা সুখ লাভে সহায়তা করে। ২০০৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জরিপকারী সংস্থা গ্যালাপ বিভিন্ন দেশের মানুষকে জিজ্ঞেস করেছে, তাঁদের জীবন কতটা সন্তোষজনক। ফলাফলে দেখা গেছে, যে দেশ যত ধনী, সেই দেশের মানুষের সুখ তত বেশি।

 পরিসংখ্যানে রূপান্তর করলে দেখা যায়, সুখের সঙ্গে টাকার আন্তসম্পর্ক আছে। অর্থাৎ মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দ্বিগুণ হলে মানুষের সন্তোষের মাত্রা শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ে।

তবে ব্যাপারটা সরল অঙ্কের মতো বলে দেওয়া যায় না যে দেশ ধনী হলে মানুষের সুখও বাড়বে। ১৯৭৪ সালে অর্থনীতিবিদ রিচার্ড ইস্টারলিন দেখেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের গড়পড়তা সন্তোষের মাত্রা ১৯৪৬ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে স্থবির হয়ে পড়েছে, যদিও এই সময়ে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। তিনি অন্যান্য দেশেও এই দুটি বিষয়ের মধ্যকার সম্পর্কে ভিন্নতা দেখতে পান। তবে এটা ঠিক, অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য না থাকলে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেই মানুষের সুখ নিশ্চিত হবে, তার নিশ্চয়তা নেই।

তবে ইস্টারলিনের এই আপাত–স্ববিরোধ মডেল নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। অনেক অর্থনীতিবিদের দাবি, উন্নত মানের তথ্য–উপাত্ত ব্যবহার করে তাঁরা অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সুখের যোগ খুঁজে পেয়েছেন। ২০ মার্চ ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট বা বৈশ্বিক সুখ প্রতিবেদনে সর্বশেষ গ্যালাপ জরিপের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এতে উভয় পক্ষই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো রসদ পেয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এর মাজেজা হলো, এই আপাত–স্ববিরোধ জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মতো জীবিত আছে।

এবার কিছু বাস্তব উপাত্ত দিয়ে ব্যাপারটা দেখা যাক। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে চীন। চীনের মাথাপিছু জিডিপি গত এক দশকে দ্বিগুণ হয়েছে, তা ঠিক। কিন্তু গড়পড়তা সুখের মান মাত্র শূন্য দশমিক ৪৩ পয়েন্ট বেড়েছে। সুখ একই হারে না বাড়লেও সেখানে সুখ ও সমৃদ্ধি মোটামুটি হাত ধরাধরি করে চলছে। ধনী দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির জিডিপি ও সুখ উভয়ই গত ১০ বছরে বেড়েছে। ভেনেজুয়েলা একসময় বিশ্বের পঞ্চম সুখী দেশ হলেও অর্থনৈতিক দুর্দশার সঙ্গে তার সুখও পালিয়েছে।

বিভিন্ন দেশের উদাহরণে দেখা যায়, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সুখের আন্তসম্পর্ক আছে। তবে এই আন্তসম্পর্ক খুবই দুর্বল। দ্য ইকোনমিস্ট–এর কাছে যে ১২৫টি দেশের উন্নত মানের তথ্য-উপাত্ত আছে তাতে দেখা যায়, ৪৩টি দেশে মাথাপিছু জিডিপি ও সুখের সম্পর্ক বিপরীতধর্মী।

অন্যদিকে চীনের মতো ভারতও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ। গত ১০ বছরে দেশটিতে মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ ৮০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এই সময়ে দেশটিতে গড়পড়তা সুখের মাত্রা ১ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। দ্য ইকোনমিস্ট–এর চোখে যা উল্লেখযোগ্য। ইস্টারলিনের গবেষণার প্রথম ক্ষেত্র ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে আবারও দেখা গেছে, গত বছর দেশটির প্রবৃদ্ধি ভালো হলেও সুখের মাত্রা কমেছে। ইউরোপের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। এই মহাদেশে মানুষের সন্তোষের মাত্রা অনেক উঁচুতে তা ঠিক, তবে সমৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও সেখানকার মানুষের সন্তোষের মাত্রা কমছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো আরও যেসব দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের সুখ কমেছে সেগুলো হলো: কানাডা, জাপান, নেদারল্যান্ডস, জাপান, সুইডেন,দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি।

 দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, সারা পৃথিবীর মানুষ এই দুই শিবিরে প্রায় সমানভাবে বিভক্ত: সুখের সঙ্গে টাকার সম্পর্ক আছে বা টাকার সঙ্গে সুখের সম্পর্ক নেই।