বিকল্প পথের সন্ধানে সরকার

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এখন এক লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে আ হ ম মুস্তফা কামাল ব্যাংক খাতের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এই খেলাপি ঋণকে। সাংবাদিকদের সামনে তিনি এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন যে খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও তিনি বাড়তে দেবেন না। তার অংশ হিসেবেই বিকল্প পথ খুঁজছে সরকার। আর সে পথটি হচ্ছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা (অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট) কোম্পানির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় করা।

খেলাপি ঋণ আদায়ে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠনের প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য এরই মধ্যে একটি কমিটি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তিন সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটির আহ্বায়ক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব মু. শুকুর আলী। অপর দুই সদস্য হলেন একই বিভাগের উপসচিব সাঈদ কুতুব এবং অগ্রণী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিছুর রহমান।
কমিটির কার্যপত্রে পাঁচটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে: সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠনের প্রয়োজনীয়তা, গঠন প্রক্রিয়া, সম্পদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, আইন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা (যদি থাকে) এবং এ বিষয়ে অন্যান্য দেশের রীতিনীতি পর্যালোচনা। কমিটিকে সুপারিশসহ ৩১ মার্চের মধ্যে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘উদ্যোগটি ভালো। তবে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর যেমন নোংরা ভূমিকা দেখা গেছে, তা না থাকলেই হলো। ব্যাংক এমনকি তথ্যই দিতে চায় না। আবার ভালোগুলো নিজেদের কাছে রেখে খারাপ ঋণ আদায়ের দায়িত্ব অন্যদের দিতে চায়, যেগুলো আদায় করা খুবই কঠিন।’
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১৮ মার্চ শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে ব্যাংক খাতের প্রায় সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করার পর সাংবাদিকদের জানান, দেশে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি নেই। তিনি চান এ ধরনের কোম্পানি হোক এবং তিনি মনে করেন, খেলাপি ঋণ আদায়ে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। এর আগে ১৪ মার্চ বিভিন্ন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রাক্-বাজেট আলোচনায়ও অর্থমন্ত্রী একই কথা বলেন।
অর্থমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যের পরই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করল। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২৭ মার্চ সচিবালয়ে কমিটির প্রথম বৈঠক হবে।

তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের এবারের উদ্যোগটিও নতুন নয়। ২০০১ সালেও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করে তৎকালীন সরকার। ২০০৩ সালে বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের সহযোগিতায় সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস করপোরেশন (পিডিএসসি) লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে খেলাপি ঋণ আদায় কার্যক্রম শুরু করে। পরে এ–জাতীয় আরও কোম্পানি গড়ে ওঠে এবং সোনালী, অগ্রণীসহ কয়েকটি ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ের দায়িত্ব দেয়। শুরুর দিকে ভালো সাফল্য আসে। কিন্তু একশ্রেণির অসাধু ব্যাংকার ও ব্যাংকের প্যানেল আইনজীবীদের অসহযোগিতায় কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম বন্ধের পথে। জানা গেছে, বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেও মামলা পরিচালনার দায়িত্ব ব্যাংকগুলো তাদের হাতেই রাখে। একশ্রেণির আইনজীবী ঋণখেলাপিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে মামলা দীর্ঘায়িত করে ফেলেন।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিগুলো পিডিএসসির মতো প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন হবে। সহজ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দেখা গেছে ১০০ টাকার একটা ঋণ একটা কোম্পানি কিনে নিল ৭০ টাকায়। পুরো টাকা আদায় করতে পারলে ৩০ টাকা হবে ওই কোম্পানির লাভ। এ ছাড়া দায়ের (লায়াবিলিটি) দায়িত্ব নেওয়া বা ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী মামলা চালিয়ে যাওয়াও কোম্পানিগুলোর কাজ হতে পারে। যদিও বিষয়টা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।’
সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিতে পুরোপুরি বেসরকারি মালিকানা থাকা একটা বড় সমস্যা। কিছুটা সরকারি মালিকানা থাকলে ভালো। তবে কোম্পানিগুলোতে দক্ষ লোক থাকাটা জরুরি। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতাটাও সব সময়ই তাদের নিতে হবে।