ঋণখেলাপিদের জন্য আরও সুবিধা

>

*৭% সুদে ঋণ শোধের সুযোগ
*সময় পাবেন ১২ বছর
*কার্যকর ১ মে থেকে
*অন্যায্য সুবিধার অভিযোগ

মোট ঋণের মাত্র ২ শতাংশ এককালীন জমা (ডাউন পেমেন্ট) দিয়ে একজন ঋণখেলাপি নিয়মিত গ্রাহক হয়ে যাবেন। বাকি ঋণ শোধ করতে হবে ১২ বছরের মধ্যে। ঋণের সুদহার ১০, ১২ বা ১৫ যা-ই থাকুক না কেন, নেওয়া হবে মাত্র ৭ শতাংশ। আগামী এক মাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করবে, যা কার্যকর হবে ১ মে থেকে।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের কার্যালয়ে গতকাল সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরসহ অন্যদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের এসব কথা জানান। বৈঠকে অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান পাটোয়ারী, অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে ২০১৫ সালে ঋণখেলাপিদের জন্য ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন ১১টি শিল্প গ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করে বড় ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়। তবে সুবিধা পাওয়ার পরও দুটি গ্রুপ ছাড়া আর কেউ টাকা পরিশোধ করছে না।

জানা যায়, ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১৮ সাল শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। এ ছাড়া অবলোপন ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি মইনুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ঋণখেলাপিদের অন্যায্য সুবিধা দেওয়ার জন্য এসব খামখেয়ালিপনা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী একজন ব্যবসায়ী হিসেবে খেলাপিদের জন্য এসব সুবিধা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। মনে হচ্ছে, সময়টা ঋণখেলাপিদের। নতুন সিদ্ধান্ত খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রভাব ফেলবে না, বরং একে খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত বলা যায়।

মইনুল ইসলাম বলেন, ঋণখেলাপিদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে। উচ্চ আদালতে যেন বেশি দিন সুবিধা না পায়, তারও উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলেই তারা ঋণ ফেরত দিতে পারে।

দেশে দুই ধরনের ঋণগ্রহীতা রয়েছে, ভালো ও অসাধু—এ কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভালোদের সুযোগ দেব আর অসাধুদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করব। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা আজ বসেছিলাম। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হননি বা বেশ কিছু কিস্তি দেওয়ার পর সুনির্দিষ্ট কারণে শোধ করতে না পেরে খেলাপি হয়েছেন, তাঁদের জন্য এ সুযোগ।’

ভালো ঋণগ্রহীতাদের সুদের হার কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এককালীন ২ শতাংশ পরিশোধের পর যা বাকি থাকবে, তার ওপর সরল সুদ নেওয়া হবে ৭ শতাংশ হারে। পুরো ঋণ পরিশোধে তাঁদের সময় দেওয়া হবে ১২ বছর। ছোট বা বড় সব ঋণগ্রহীতার জন্যই তা প্রযোজ্য। কেউ যদি মনে করেন যে একবারে টাকা পরিশোধ করে চলে যাবেন, সেই ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে।

ভালো বা অসাধু বাছাই করা হবে কীভাবে, জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী জবাব দেন তাঁর দুটি প্রশ্নের মাধ্যমে। বলেন, ‘২ বছর বা ১০ বছরের জন্য ঋণ নিলাম, এক টাকাও ফেরত দিলাম না, আমি কি ভালো? রপ্তানি করলাম ১০ বার, একবারের টাকাও দেশে ফেরত এল না, আমি কি ভালো?’ তবে ব্যাংকগুলোতে যে বিশেষ নিরীক্ষা হবে, তার মাধ্যমেই ভালো ও অসাধু ঋণগ্রহীতা চিহ্নিত হবে বলে মনে করেন তিনি। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বহু আগে থেকেই আমরা বলে আসছিলাম, সুদের হার এক অঙ্কের হবে, এত দিনেও তা হয়নি। এখন এক অঙ্কের ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই করছি।’

ঋণখেলাপিদের জন্য এই ছাড় কবে থেকে কার্যকর হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কাজ শুরু করেছি। সর্বোচ্চ এক মাস সময় লাগবে। তবে তা কার্যকর হবে আগামী ১ মে থেকে।’

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার শুরুতেই অর্থমন্ত্রী জানিয়ে দেন, সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের নেওয়া কিছু পদক্ষেপের ধারাবাহিকতা থেকে। মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকার সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুরবস্থার কথা চিন্তা করেছিলেন। আসলে ব্যাংকারদের লাগবে, ঋণগ্রহীতাদেরও লাগবে। ঋণগ্রহীতাদের বিকল্প নেই। কারণ, তাঁরাই কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেন, দারিদ্র্য দূর করেন এবং অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেন। ঋণগ্রহীতাদের বাদ দিয়ে চলার কোনো ব্যবস্থা নেই।

অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায় বিশাল ঝুঁকি আছে এবং ব্যবসা করতে গেলে শুধু লাভ হয় না, লোকসানও হয়। যখন লাভ হয়, তখন সবাই খুশি। সরকারও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) পায়। কিন্তু লোকসান হলে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের কিছু দেওয়া হয় না। বরং মাসে মাসে তাঁদের ওপর সুদ হিসাব করা হয়। তা–ও আবার চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করতেই সাবেক অর্থমন্ত্রী কাজটি করেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের কারণে তিনি কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের বৈঠক।

এদিকে কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সরকার থেকে এসব সুবিধা দেওয়া হবে, এমন আশ্বাস দেওয়ার পর অনেক ঋণগ্রহীতা আর টাকা শোধ করছেন না। তাঁরা বলছেন, নতুন প্রজ্ঞাপন হবে। সুদহার কমবে। এরপরই তাঁরা ঋণ পরিশোধের বিষয়ে এগোবেন। আসলে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তার তহবিল খরচ ছিল ১০ শতাংশের ওপরে। এখন ৭ শতাংশে পরিশোধ হলে ব্যাংকগুলো লোকসানে পড়বে।