অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বল খাত ব্যাংক

চলতি অর্থবছরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী পাঁচ দেশের একটি হবে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন হতে পারে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আর এই অর্থবছরে এর চেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে আফ্রিকার ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডা এবং এশিয়ার ভুটান ও ভারতে।

এই সুসংবাদ দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বল দিকটির কথাও বলেছে। আন্তর্জাতিক এই দাতা সংস্থা মনে করে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বল খাত হচ্ছে ব্যাংক। এখানে ঢালাওভাবে ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়। অথচ একই ব্যবসায়ীকে একই যুক্তিতে বারবার পুনঃ তফসিলের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে না। এই অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নিয়মিত প্রকাশনা ‘ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। এ সময় আরও বক্তব্য দেন কান্ট্রি ডিরেক্টর রবার্ট জে সউম।

প্রবৃদ্ধিতে শিল্প খাতই প্রধান

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে, চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। আরেক দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পূর্বাভাস হচ্ছে, বৃদ্ধি হবে ৮ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিল্প খাতই প্রবৃদ্ধিতে প্রধান ভূমিকা রাখছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থবছরের আট মাস সময়ে রপ্তানি বেড়েছে ১৩ শতাংশ। অন্যদিকে মেগা প্রকল্প ও প্রবাসী আয়ের কারণে নির্মাণ খাতে অগ্রগতি বেশ ভালো। চালের উৎপাদনও ভালো। বিদ্যুৎ উৎপাদনে উন্নতি হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কিছুটা আস্থা ফিরে এসেছে। তবে সার্বিকভাবে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ এখনো অপর্যাপ্ত। জিডিপির অনুপাতে ব্যক্তি বিনিয়োগ এক জায়গায় আটকে আছে। বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ তেমন বাড়েনি। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। রাজস্ব আয় দুর্বল এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রাজস্ব আদায়ে মাত্র ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা গত ১৬ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আবার টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য সংস্কারের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। সংস্কারের অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলো হলো আর্থিক খাত, রাজস্ব খাত, অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং ব্যবসা সহায়ক নিয়মকানুন।

এত চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির পরও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ হিসেবে মন্তব্য করেছে বিশ্বব্যাংক। আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ৮ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে ইথিওপিয়ায়। এ ছাড়া রুয়ান্ডায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, ভুটানে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ ও ভারতের সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এ ছাড়া জিবুতি, আইভরি কোস্ট, ঘানা—এই চারটি দেশেরও বাংলাদেশের সমান প্রবৃদ্ধি হবে।

বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর রবার্ট জে সউম বলেন, প্রবৃদ্ধিকে টেকসই করতে বাংলাদেশের সামনে নানা চ্যালেঞ্জ আছে। বিশেষ করে বেসরকারি বিনিয়োগ চাঙা করা এবং রপ্তানিপণ্যে বৈচিত্র্য আনা। এ ছাড়া খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাংক খাত ভুগছে। বাংলাদেশকে বড় ধরনের সংস্থার করতে হবে।

ব্যবসায় সহায়ক নীতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের মত হলো, এ দেশে অনানুষ্ঠানিক খাতের ছোট ব্যবসায়ীরা নিয়মনীতির আওতার বাইরে থাকে। আবার বড় ব্যবসায়ীরা নিয়মনীতি কিংবা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সব মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাঝারি ব্যবসায়ীরা।

আর্থিক খাতের ঝুঁকি

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংক দেখিয়েছে, বিদ্যমান খেলাপি ঋণ যদি ৩, ৯ ও ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, তাহলে যথাক্রমে ৬, ২৯ ও ৩৫টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়তে পারে। আবার প্রতিটি ব্যাংকের যদি শীর্ষ তিনজন, সাতজন ও দশজন ঋণগ্রহীতা খেলাপি হয়ে যান, তবে মূলধন ঘাটতিতে পড়তে পারে যথাক্রমে ২১টি, ৩১টি ও ৩৫টি ব্যাংক। অন্যদিকে জামানতের বিপরীতে রাখা বন্ধকি সম্পত্তির বিক্রয়মূল্য যদি ১০, ২০ ও ৪০ শতাংশ কমে যায়, তবে যথাক্রমে ২, ৫ ও ৯টি ব্যাংক এমন বিপদে পড়তে পারে।

এই বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এতে ঘূর্ণিঝড় নয়; মেঘ ঘনীভূত হবে।’ তিনি আরও বলেন, খেলাপি ঋণের পুনঃ তফসিল করার অর্থনৈতিক যুক্তি হলো, এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যার নিয়ন্ত্রণ ঋণগ্রহীতার হাতে নেই, ফলে ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে। এমন বিপদে পড়া ঋণগ্রহীতাকেই এই সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু এখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। সবাই কি অনিচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি? না। বারবার একই ব্যক্তিকে একই যুক্তিতে পুনঃ তফসিলের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে না। খেলাপি ঋণের পুনঃ তফসিলীকরণ ছোঁয়াচে রোগকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলছে, ২০১৮ সাল শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। কেবল ২০১৮ সালেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, যা গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পাঁচটি ব্যাংকে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ আছে, তা মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক। মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতেই আছে ৩১ শতাংশ এবং রাষ্ট্রমালিকানাধীন উন্নয়ন ব্যাংকগুলোতে আছে ২২ শতাংশ।

খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ আছে বলে মনে করে বিশ্বব্যাংক। এগুলো হলো নির্দেশিত ঋণ, নিম্নমানের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং দুর্বল করপোরেট সুশাসন। বিশ্বব্যাংকের মতে, ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের অভ্যাস এবং ঋণ অবলোপন করার প্রবণতা বেড়েছে, যা ব্যাংক খাতে চাপ সৃষ্টি করছে। ঢালাওভাবে ঋণ পুনঃ তফসিল করার কারণেই ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।

ঋণ অবলোপন করার ক্ষেত্রে নিয়ম শিথিল করা নিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া প্রজ্ঞাপনের সমালোচনা করে বিশ্বব্যাংক বলেছে, এই উদ্যোগ ব্যাংকের উদ্বৃত্তপত্রকে (ব্যালান্স শিট) জঞ্জালমুক্ত রাখবে। কিন্তু এটি ঋণখেলাপিদের প্রতি ভুল বার্তা দিতে পারে। খেলাপি হওয়া ঋণ আদায় উদ্যোগকে দুর্বল করে দিতে পারে।

ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার তাগিদ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমিত স্বাধীনতা এবং আইনবিধি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের অভাবে ব্যাংক খাতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি হচ্ছে না। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মালিক জনগণ। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মালিকানার ভূমিকা পালন করে। নিয়ন্ত্রক ও মালিকের ভূমিকা এক নয়। তাই আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।

এ প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, ফাউল প্লে করলে রেড কার্ড, ইয়েলো কার্ড আছে। সে জন্য রেফারি আছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব রেফারির মতো। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা যদি দক্ষতা, স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তবে কোনো সমস্যা হয় না। আবার সব ব্যাংককে এক পাল্লায় মাপাও ঠিক হবে না।