সূচকের 'নিয়ন্ত্রিত' উত্থান-পতন

>

• নির্বাচনের পর ডিএসইর প্রধান সূচক বেড়েছিল ৫৬৪ পয়েন্ট
• আবার ৫১৬ পয়েন্ট কমে সূচক এখন আগের অবস্থানে
• কয়েক বছর ধরে সূচকের নিয়ন্ত্রিত উত্থান-পতন ঘটছে
• প্রতিবারের উত্থান-পতনে সূচকের ৪০০-৮০০ পয়েন্টের তারতম্য
• সূচকের উত্থান-পতনে বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর বড় প্রভাব

দেশের শেয়ারবাজারে সূচকের ‘নিয়ন্ত্রিত’ উত্থান-পতন চলছে। বছরে দু-তিন মাসের ব্যবধানে বাজারে সূচকের উত্থান যেভাবে হচ্ছে, পতনও হচ্ছে সেভাবেই। বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কিছুসংখ্যক বিনিয়োগকারী কারসাজির মাধ্যমে সূচকের ওপর এ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে লাভবান হচ্ছেন। বিশেষ করে রাজনীতি ও নির্বাচনসহ জাতীয় বিভিন্ন ইস্যু, জাতীয় বাজেট ও নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে বাজারে সূচকের উত্থান-পতন ঘটানো হচ্ছে।

চলমান ধারাবাহিক পতনে শেয়ারবাজার ফিরে গেছে গত জাতীয় নির্বাচনের আগের অবস্থায়, যখন (২৭ ডিসেম্বর) ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫৩৮৬ পয়েন্টে এবং তখন মোট লেনদেন ছিল ৫৩৮ কোটি টাকা। গতকাল রোববার ওই সূচক নেমেছে ৫৪৩৪ পয়েন্টে এবং লেনদেন কমে হয়েছে ৩৩১ কোটি টাকা। অথচ গত তিন মাসের এই সময়ের মধ্যে সূচক বেড়ে হয়েছিল ৫৯৫০ পয়েন্ট এবং লেনদেন বেড়ে হয়েছিল প্রায় ১২০০ কোটি টাকা।

প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) গত পাঁচ বছরের উত্থান-পতনের তথ্য বিশ্লেষণ করে বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে সূচকের নিয়ন্ত্রিত উত্থান-পতন ঘটছে। প্রতিবারের উত্থান-পতনে সূচকের ৪০০ থেকে ৮০০ পয়েন্টের তারতম্য ঘটে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর থেকেই বাজারে সূচকের একধরনের নিয়ন্ত্রিত উত্থান-পতন চলছে। দেখে মনে হচ্ছে কারসাজির মাধ্যমে সূচকের ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে একশ্রেণির সুচতুর বিনিয়োগকারী বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার থেকে মুনাফা তুলে নেন। তিনি বলেন, এর পেছনে বড় ধরনের কোনো কারসাজি রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে গভীরভাবে তদন্ত করা দরকার। তা না হলে বারবারই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

বাজারসংশ্লিষ্ট একাধিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনায় আগ্রহী হন মূলত সূচকের উত্থানপর্বে। আর তখনই বড় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তাতে সূচক দ্রুত কমতে থাকে। পতনের একপর্যায়ে এসে বড় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনতে শুরু করেন। দাম বাড়তে শুরু করলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজারে সক্রিয় হন, তখনই বিক্রি শুরু করেন বড় বিনিয়োগকারীরা এবং মুনাফা তুলে নিয়ে সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় হন।

সূচকের উত্থান-পতনে বড় মূলধনি কোম্পানিগুলোর বড় প্রভাব রয়েছে। এসব কোম্পানির শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধিতে সূচক বাড়ে আর দরপতনে সূচক কমে। এ কারণে সূচকের উত্থান-পতন ঘটানোর জন্য বড় মূলধনি কোম্পানির শেয়ার বেছে নেন কারসাজিকারকেরা। বাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পতনের ধারা থেকে যখনই বাজারকে টেনে তোলার চেষ্টা হয়, তখনই শুরুতে বড় মূলধনি কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো হয়। এরপর বাজার উত্থানের ধারায় ফিরলে ভালো কোম্পানির শেয়ারের চেয়ে মন্দ কোম্পানির শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ ধরনের ২৫ থেকে ৩০টি কোম্পানি রয়েছে, যেগুলোর দাম গত এক বছরে কারণ ছাড়াই অস্বাভাবিক বেড়েছে। সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। গত বছরের ৮ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ১৮ টাকা। গতকাল দিন শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ টাকায়। একই সময়ে দ্বিগুণ হয়েছে মুন্নু সিরামিক, বিডি অটোকারসের শেয়ারের দাম। আর বন্ধ কোম্পানি এমারেল্ড অয়েলের শেয়ারের দাম গতকাল এক দিনেই ১০ শতাংশ বা ১ টাকা ৬০ পয়সা বেড়েছে। ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, কারসাজির ঘটনা ছাড়া মন্দ কোম্পানির শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।

মানহীন আইপিও এবং প্লেসমেন্টের অনানুষ্ঠানিক বাজার
বাজারের তারল্য কমে যাওয়ার জন্য বাজারসংশ্লিষ্টরা মানহীন কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিও এবং প্লেসমেন্ট শেয়ারের রমরমা বাণিজ্যকেও কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসইর সাবেক এক পরিচালক বলেন, সেকেন্ডারি বাজারের বাইরে প্লেসমেন্টের অনানুষ্ঠানিক আরেকটি রমরমা বাজার গড়ে উঠেছে। লোভে পড়ে এবং লাভের আশায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনেকেই বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে প্লেসমেন্টে বিনিয়োগ করছেন। বাজারে তারল্য সংকট তৈরির এটা বড় কারণ। প্লেসমেন্টের ক্ষেত্রে ফরোয়ার্ড সেল বা হাতবদল হচ্ছে। একজন কম দামে শেয়ার কিনে বাড়তি দামে অন্যের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে তালিকাভুক্ত কিছু কোম্পানির আইপিও শেয়ারও বাজারে তারল্য-সংকট তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হয় জেনেক্স ইনফোসিসের। লেনদেনের প্রথম দিনেই কোম্পানিটির ১০ টাকার আইপিও শেয়ারের দাম ওঠে সাড়ে ৫৬ টাকায়। গতকাল দিন শেষে তা কমে হয় ৩৮ টাকা। একই ঘটনা ঘটেছে এসএস স্টিল, কাট্টলি টেক্সটাইল, ইন্দো বাংলা, সিলভা ফার্মাসহ সাম্প্রতিক লেনদেন শুরু হওয়া বিভিন্ন কোম্পানির বেলায়। লেনদেনের শুরুতে এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম আইপিও মূল্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তাতে আইপিও শেয়ারধারীরা তাঁদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে মুনাফা তুলে নেন। পরে সেকেন্ডারি বাজার থেকে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে বিনিয়োগকারীদের অনেকেই লোকসানের মুখে পড়েন, তাঁদের টাকা আটকে যায়।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল বলেন, বাজারে চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও মানহীন কোম্পানির আইপিও অনুমোদন দিয়ে সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। তাতে মন্দা বাজার থেকেও টাকা চলে গেছে। অনেক সময় ভালো কোম্পানি বাজারে এলে তার সঙ্গে সঙ্গে কিছু নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আসেন। কিন্তু বর্তমানে যেসব কোম্পানি বাজারে আসছে, সেগুলোর বেলায় ঘটছে উল্টোটি। এতে করে বাজারে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে একধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাজারে।

দরপতনে লেনদেন কমছে
গত চার কার্যদিবসে মৌলভিত্তির গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম ৪২ টাকা কমে গেছে। তাতে ১ এপ্রিল যাঁরা কোম্পানিটির শেয়ার কিনেছিলেন, তাঁদের প্রতি শেয়ারে লোকসান ৪২ টাকা। টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা পাওনার নোটিশ জারি হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বাজারে শীর্ষ এই কোম্পানির দরপতন ঘটেছে বলে বাজারসংশ্লিষ্টদের ধারণা।

এদিকে লেনদেনে শীর্ষে থাকা বিদ্যুৎ খাতের বড় কোম্পানি ইউনাইটেড পাওয়ারের দাম গত চার কর্মদিবসের ব্যবধানে কমেছে ৩৪ টাকা। বিদেশি বিনিয়োগকারীর কাছে কোম্পানিটির প্রায় ১২০০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি চূড়ান্ত করা নিয়ে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে দর-কষাকষির জের ধরে এই দরপতন ঘটে বলে একাধিক ব্রোকারেজ হাউস সূত্রে জানা গেছে।

বড় এই দুটি কোম্পানিসহ মৌলভিত্তির আরও কিছু কোম্পানির দরপতন হওয়ায় বাজারে সক্রিয় বিনিয়োগকারীদের অনেকেই লেনদেন সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সূচক ও লেনদেনে।

সূচকের উত্থান-পতন
ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮ সালে ছয়বার সূচকের বড় ধরনের উত্থান-পতন ঘটে। তাতে সূচকের তারতম্য ঘটে ৪০০ থেকে প্রায় ৮০০ পয়েন্ট। ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ মার্চ সময়কালে ডিএসইএক্স সূচকটি ৭৬৫ পয়েন্ট কমেছিল। এরপর দুই সপ্তাহের মধ্যে তা প্রায় ৪০০ পয়েন্ট বেড়ে যায়।

ওই বছরের ৪ জুন পর্যন্ত ডিএসইএক্স সূচকটি আবারও ৫৬৫ পয়েন্ট কমে যায়। এরপর তা ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ৩০০ পয়েন্টের মতো বাড়ে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সূচকটি ৪০৭ পয়েন্টের মতো কমে যায়। নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাজারে মন্দাভাব বজায় ছিল।

গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর সূচক এক মাসে ৫৬৪ পয়েন্ট বেড়ে যায়। এরপর ধারাবাহিক পতন চলছে। গত ২৮ মার্চ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘পুঁজিবাজার আমার জন্য চ্যালেঞ্জের। আমি হিসাবের লোক। লোকসান দেব না, লাভ দেব। যারা বিনিয়োগ করবে, তাদের বিজয়ী করব।’ অর্থমন্ত্রী পুঁজিবাজারের প্রতি সরকারের সুনজর থাকার কথা উল্লেখ করেন। তবে অর্থমন্ত্রীর ওই ঘোষণার পরও সূচক ও লেনদেনের খরা কাটছে না।