বিশ্ব অর্থনীতিতে বয়সের প্রভাব কতটা

বাড়ছে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। ছবি: রয়টার্স
বাড়ছে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বে তরুণদের চেয়ে বাড়ছে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। বর্তমানে পাঁচ বছর বয়সের নিচের জনগোষ্ঠীর চেয়ে ৬৫ বছরের ওপরের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি। এমনটা এর আগে দেখেনি এই বিশ্ব। সম্প্রতি ডয়েচে ব্যাংকের টরস্টেন স্কলের এক গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বয়স্ক মানুষের কর্মতৎপরতা বিশ্ব অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলছে, তা-ই এখন আলোচনার বিষয়।

টরস্টেন স্কল বলছে, দুই দশক পর প্রতি একজন পাঁচ বছর বয়সের নিচের জনগোষ্ঠীর বিপরীতে দুজন ৬৫ বছরের ওপরের জনগোষ্ঠী থাকবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যমতে, ২০১৫ সাল থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ৬০ বছরের বেশি বয়সের জনসংখ্যা ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২ শতাংশ হবে। এ ছাড়া ৮০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ শতাংশ হবে।

এই তথ্যে উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদেরা। সাধারণভাবে এটাই স্বীকৃত যে কর্মক্ষম মানুষ বেশি থাকলে প্রবৃদ্ধি বেশি হবে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, অবসরভাতা বৃদ্ধিসহ, দুর্বল চাহিদা ও অতিরিক্ত সঞ্চয় থাকার কারণে স্বল্পমেয়াদি কম সুদহারের মতো কার্যকর উপকরণ দিয়েও প্রবৃদ্ধিতে গতি ফেরানো যাবে না।

এটা হয়তো অবশ্যম্ভাবী যে ধূসর বিশ্ব এগিয়ে আসছে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এর নেতিবাচক প্রভাব থাকবেই এটা আবশ্যিক নয়। যদি বয়স্ক জনগোষ্ঠী গতিশীল কার্যক্রম পরিচালনা করে, তবে এর নেতিবাচক প্রভাব নাও হতে পারে। এ ছাড়া এই জনগোষ্ঠীর ভোটের মূল্যও তাঁদের ব্যাপক গুরুত্ব তুলে ধরে। দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রথমেই বুঝতে হবে প্রবীণ জনগোষ্ঠী প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেন—এমন ধারণা কেন প্রচলিত। এক. উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যায়। বর্তমানে জনসংখ্যার এই পরিবর্তনের কারণে প্রায় ৪০টি দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমেছে। প্রবীণ জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায়, সরকারও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিকারী বিনিয়োগ যেমন শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ কমিয়ে দিচ্ছে। বরং বেশি বিনিয়োগ করছে অবসর ভাতা ও স্বাস্থ্য খাতে। দুই. এই বয়স্ক জনগোষ্ঠীর বিপরীতে যে কর্মক্ষম মানুষ রয়েছেন, তাঁদের ওপরও বেশি করের বোঝা চাপানো হচ্ছে। তবে প্রবৃদ্ধির বড় ধাক্কা আসছে উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়ার জন্য।

এবার প্রশ্ন ওঠে, আসলেই কী প্রবীণ জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা কম? তাই বলে এমন নয় যে কাজে তাঁদের সামর্থ্য কম, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের শক্তি কমে যায়, তাই তাঁদের উৎপাদনশীলতা কম। ২০১৬ সালে জার্মানির উৎপাদন খাতের এক গবেষণা ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা কমানোর কারণ খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়। কোম্পানিগুলো অভিজ্ঞতা, প্রফেশনাল কানেকশন কাজে লাগিয়ে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সঠিক সদ্ব্যবহার করতে পারেন। আসলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা কমানোর কোনো কারণ যদি বলতেই হয় তা হলো বেতন কাঠামো। মূলত কর্মজীবনের শুরুতে বেতন বৃদ্ধি হতে থাকে। শেষের দিকে কমতে থাকে। তবে সব সময় এমনটা হয় না।

মুডিস অ্যানালাইটিকসের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক কোম্পানিতে বয়স্ক কর্মীদের চেয়ে অন্যদের বেতন অনেক কম থাকে। এর মূল কারণ তাঁদের প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা। তবে কী ধরনের প্রভাব, তা পরিষ্কার নয়। তবে ওই গবেষণার লেখকেরা বলেন, যেসব কোম্পানিতে বয়স্ক কর্মী বেশি, তাঁরা বেশি প্রযুক্তিবিমুখ। এর কারণ হতে পারে কর্মীদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য আর বিনিয়োগ করতে তাঁরা ইচ্ছুক নন। কারণ, নিজেদের কর্মজীবনের শেষ পর্যায়ে এসে ওই প্রশিক্ষণের ফলাফল পাওয়ার আশা তাঁরা করেন না। গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণ বস বয়স্ক বসের তুলনায় বেশি প্রযুক্তিবান্ধব। এটি সুস্পষ্ট যে পুরোনো মানুষের নতুন প্রযুক্তির প্রতি বৈপরীত্য বেশি। বয়স্ক মানুষেরা পরিবর্তন পছন্দ করেন না। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রবীণ জনগোষ্ঠী রয়েছে জাপান, ইতালি, কানাডা, জার্মানির মতো দেশে। তবে চীন ভারতের মতো দেশগুলোতেও খুব দ্রুত এই সংখ্যা বাড়ছে। তরুণ জনগোষ্ঠী কম মানে কর্মীর সংখ্যাও কম। ফলে পণ্য ও সেবার উৎপাদন কমবে, যা দিয়ে বিশ্বব্যাপী বাকি জনগোষ্ঠীর জন্য পরিষেবা সরবরাহ করা যাবে।

এই অবস্থায় আসলে সমাধান কী হতে পারে? যে অর্থনীতিতে তরুণ কর্মক্ষম কর্মীর সংখ্যা কম, অবসরভাতায় বেশি ব্যয় হচ্ছে তারা কর্মের বয়স সীমা বাড়িয়ে একটা সমাধানে আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অবসরকালীন বয়স বাড়িয়ে দিয়ে। তবে এ ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে প্রযুক্তির প্রতি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর অনীহা। সে ক্ষেত্রে অন্য লক্ষ্যগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষ করে, প্রতিযোগিতার বৃদ্ধি এবং চাকরি পরিবর্তনের সুযোগের বাধা ভেঙে ফেলা।

তবে বয়স্ক অর্থনীতির কারণে প্রবৃদ্ধি কমার শঙ্কা থাকলেও ভোটার সংখ্যা কমে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। প্রবীণ বেশি মানে ভোটার সংখ্যা বেশি। রাজনৈতিক দিক দিয়ে এই জনগোষ্ঠীর গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এ ধরনের ভোটাররা তরুণ ভোটারের তুলনায় বেশি রক্ষণশীল হন। প্রচলিত যে রাজনীতির ধারা চলছে তাতেই সমর্থন দেন। নতুন আগমনের প্রতি অতটা ভরসা রাখেন না। যেসব দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী বেশি, তাঁদের যদি গতিশীল অপ্রচলিত সমাজ অথবা স্থির প্রচলিত সমাজের মধ্যে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে তাঁরা দ্বিতীয়টি বেছে নেন। তবে রাজনীতিবিদদের এই বোধোদয় হওয়া জরুরি, যে জনসংখ্যার পরিবর্তন সমৃদ্ধ দেশের শিল্পায়নের সঙ্গে জড়িত, তা লাভই নিয়ে আসে। নতুন প্রযুক্তি এবং তার সুযোগ গ্রহণের ফলে একটি ভালো নির্বাচনী এলাকা তৈরি হয়।

২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বয়স্ক জনগোষ্ঠী অবসরভাতা ও স্বাস্থ্যসেবার ওপর জোর দিয়েই ভোট প্রদান করেন। পরিবেশ রক্ষা, শিক্ষা এবং দারিদ্র্যের সহায়তা প্রথম পছন্দের মধ্যে থাকে না। বয়স্ক ব্যক্তিরা পলিসি-লিমিটেড নীতি যেমন দুর্নীতির বিরোধী নীতিকে হাউজিং, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি বা করের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেন।

এ ছাড়া সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, যখন তরুণ কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে যায়, উৎপাদনকারীরা যান্ত্রিকতার দিকে ঝুঁকে যান, অটোমেশনে বিনিয়োগ করেন বেশি। আর এর ফলে প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে। সেবা খাতে এখনো রোবট সে রকম কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তবে দিনে দিনে তাদের দক্ষতার উন্নতি হচ্ছে।