শেয়ারবাজারে চেয়ারম্যানের পদই কেবল স্থিতিশীল

>

• বাজার ধসের পর নিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যান এখনো বহাল
• বাজার আগের মতোই আস্থাহীন ও অস্থিতিশীল

২০১০ সালের একদম শেষ দিকে শেয়ারবাজারে ধস শুরু হলে খুবই দ্রুতগতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার পুনর্গঠন করা হয়েছিল। ২০১১ সালের ১৫ মে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নিয়োগ পান নতুন চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন। সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিল এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে, বাজার হবে স্থিতিশীল। তারপর ৯ বছর চলে গেছে। এর মধ্যে অনেক কিছুরই বদল হয়েছে। কিন্তু দুটো জিনিসের কোনো বদল হয়নি। এর একটি হচ্ছে বাজার। অর্থাৎ বাজার সেই আগের মতোই, আস্থাহীন ও অস্থিতিশীল। আর বদল হয়নি চেয়ারম্যানের। ৯ বছর ধরে এম খায়রুল ইসলাম বহাল আছেন একই পদে।

আইনে বলা আছে, বিএসইসির চেয়ারম্যানের মেয়াদ হবে চার বছর এবং আরেকটি মেয়াদের জন্য পুনর্নিয়োগ পাবেন। সে হিসাবে এই পদে তাঁর থাকার কথা আট বছর। কিন্তু তিনি আছেন নয় বছর ধরে। প্রথমবার তিন বছর, এরপর চার বছর এবং সর্বশেষ দুই বছরের জন্য তিনি চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়েছেন।

এই নিয়োগ নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। শুরুতে চেয়ারম্যানের পদটি ছিল তিন বছর মেয়াদের। ২০১২ সালে আইন সংশোধন করে মেয়াদ চার বছর করা হয়। এতে তিন বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চার বছরের জন্য আবার নিয়োগ পান এম খায়রুল হোসেন। দুই দফায় সাত বছর দায়িত্ব পালনের পর তাঁর শেষ কর্মদিবস হওয়ার কথা ছিল গত বছরের ১৪ মে। কিন্তু তার আগেই সরকার তাঁকে আরও দুই বছরের জন্য নিয়োগ দেয়। এ সময় সাবেক অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত দেশে ছিলেন না। দেশে ফিরে এভাবে নিয়োগের আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জনপ্রশাসন, অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয় চিঠি চালাচালি করেছে অন্তত চার মাস। কিন্তু বৈধতা প্রশ্নে সরকারের কোনো দপ্তরই এর সমাধান দেয়নি। কিন্তু নিয়োগ পেয়ে ঠিকই চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি। একই পদ্ধতিতে কমিশনারের দায়িত্বে আছেন অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন নিজামী।

প্রশ্ন হচ্ছে, ৯ বছরে সংস্থাটির চেয়ারম্যান কী কী করেছেন। বিএসইসির ওয়েবসাইটে বলা আছে, স্বচ্ছতা, স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলার মাধ্যমে দেশের পুঁজিবাজারকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে এম খায়রুল ইসলাম নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর কাজ নিয়ে আরও অনেক ভালো ভালো কথা লেখা আছে সেখানে। এর মধ্যে আরেকটি ভালো কথা হলো, তিনি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বিএসইসির সংস্কার করেছেন। আসলেই কি তাই?

অনেক দিন ধরে দেশের শেয়ারবাজারে দরপতন চলছে। এতে পুঁজি হারাচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আস্থা তলানিতে। টানা বিক্ষোভ করছেন বিনিয়োগকারীরা। শেয়ারবাজারের কারসাজি চক্রটি এখন আরও শক্তিশালী ও সক্রিয়। বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তারাই। সূচকের ওঠানামা খুবই নিয়ন্ত্রিত। পতন তীব্র হলে হস্তক্ষেপ করে বাজারের সূচক এক বা দুই দিনের জন্য বাড়ানো হলেও এরপরে আবার পতন শুরু হয়। এককথায় বলা যায়, শেয়ারবাজারের ওপর কোনো আস্থা নেই বিনিয়োগকারীদের। প্রশ্ন হচ্ছে, এর জন্য কে দায়ী, দায়দায়িত্ব কার।

বাজারের কয়েকটি প্রবণতার কথা এখন বলা যায়। দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে সক্রিয় এমন একজন বললেন, শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করে মূলত কারসাজিকারীরা। বেশ কয়েকজনের নামও সবাই জানেন-শোনেন। অনেক কারসাজির ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু কারসাজি রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা বিএসইসি নিতে পারেনি। এর ফলে আস্থায় চিড় ধরেছে বিনিয়োগকারীদের। আবার অনেক সময় কারসাজির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, তদন্ত করাও হয়। কিন্তু তদন্ত রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখে না, ব্যবস্থাও নেওয়া হয় না। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে স্বচ্ছতার অভাব।

শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানিও কম। ভালো কোম্পানি আনতে পারেনি বিএসইসি। এমনকি বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও সরকারি অনেক কোম্পানিকে আনা যায়নি বাজারে। বরং যেসব কোম্পানি গত ৯ বছরে এসেছে, অধিকাংশের দরই এখন অবহিত মূল্যের অনেক নিচে। অথচ এসব মানহীন বা মন্দ কোম্পানিকে প্রিমিয়ামসহ বাজারে আসার অনুমোদন দিয়েছিল বিএসইসি। এসব কোম্পানি যেন টাকা তোলার জন্যই শেয়ারবাজারে আসে। আর সুযোগটি করে দিচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা স্বয়ং। এসব কোম্পানির অনুমোদন পাওয়ার পেছনের কাহিনি নিয়েও আছে অনেক মুখরোচক গল্প, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভাবমূর্তির জন্য মোটেই সহায়ক না।

আবার বাজারে আইনের প্রয়োগেও আছে নানা ঘাটতি। তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ এবং পরিচালকদের ন্যূনতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ বাধ্যতামূলক হলেও অনেক কোম্পানিই তা মানে না। কিন্তু বিএসইসি তা দেখেও যেন দেখে না।

প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওতে আসা মানহীন শেয়ারের দর যেমন অভিহিত মূল্যের নিচে, সেকেন্ডারি বাজারেও তেমনি চলে নানা কারসাজি। এর মধ্যেই আবার গড়ে উঠেছে প্লেসমেন্টের এক অবৈধ রমরমা বাজার। এই শেয়ারও বাজারে আসার আগেই একাধিক হাতবদলের ঘটনা ঘটে। এ ক্ষেত্রেও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আরও দেখা গেছে, কিছু মার্চেন্ট ব্যাংকের আইপিও দ্রুত অনুমোদন পেয়ে যায়, অন্যগুলোর ক্ষেত্রে ঘটে বিলম্ব ও দীর্ঘসূত্রতা।

দেশের শেয়ারবাজারের এসব প্রবণতা বছরের পর বছর ধরে চলছে। আর এর দায়দায়িত্ব অবশ্যই নিয়ন্ত্রক সংস্থার, পরিষ্কার করে বললে ৯ বছর ধরে বহাল থাকা চেয়ারম্যানের। যত দ্রুত তিনি দায় মেনে সঠিক ব্যবস্থা নেবেন, ততই বাজার ও বিনিয়োগকারীদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

এদিকে সরকার বলছে, দেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন খুব ভালো। বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ প্রবৃদ্ধি হতে যাচ্ছে। আয় বেড়েছে মানুষের। কিন্তু এত ভালো অর্থনীতির কোনো প্রতিফলনই শেয়ারবাজারে নেই। বরং ব্যাংকিং খাতের দৈন্যদশা, অপ্রতুল বেসরকারি বিনিয়োগ, অপর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব এবং সর্বত্র সুশাসনের অভাব—এসবেরই ছায়া দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজারে। সরকারও বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখতে পারে।