এই আমলেও পণ্যের বিনিময়ে পণ্য!

নাসিরনগর উপজেলায় শত বছর পুরোনো বিনিময় প্রথার শুঁটকি মেলা শুরু হয়েছে। মেলায় চাল, ডাল, ধান ইত্যাদি পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি কেনা-বেচা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৫ এপ্রিল। ছবি: প্রথম আলো
নাসিরনগর উপজেলায় শত বছর পুরোনো বিনিময় প্রথার শুঁটকি মেলা শুরু হয়েছে। মেলায় চাল, ডাল, ধান ইত্যাদি পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি কেনা-বেচা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৫ এপ্রিল। ছবি: প্রথম আলো

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার কুলিকুন্ডা গ্রামের কুলিকুন্ডা (দ.) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ। মাথার ওপর প্রখর রোদ থাকলেও বিদ্যালয় মাঠে মানুষের ভিড়ে জমজমাট মেলা। আর মেলার পণ্যের মধ্যে প্রধান পণ্য হলো শুঁটকি। মেলায় দুই শর বেশি ধরনের শুঁটকির পসরা নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। এর মধ্যে আছে বোয়াল, গজার, শোল, বাইম, ছুরি, লইট্টা, পুঁটি, গনা, গুচি, ট্যাংরা আইড়সহ নানান জাতের দেশীয় মাছের তৈরি শুঁটকি। এ ছাড়া মেলায় ইলিশ ও সামুদ্রিক নানা বিরল জাতের মাছের শুঁটকি রয়েছে। শুঁটকি ছাড়াও ইলিশ ও কার্পজাতীয় বিভিন্ন মাছের ডিমও রয়েছে দোকানিদের পসরায়।

কথা বলে জানা গেল, শুধু স্থানীয় লোকজন নয়, সিলেট, হবিগঞ্জ, আশুগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ভৈরবসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছেন।
মেলায় শুঁটকি ছাড়াও স্থানীয় কুমারদের হাতের তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, ঝাঁঝর, থালা, ঘটি, বদনা, বাটি, পুতুলসহ নানা ধরনের সামগ্রী আছে।

মেলায় শুঁটকি নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। পাওয়া যাচ্ছে নানা মাছের শুঁটকি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৫ এপ্রিল। ছবি: প্রথম আলো
মেলায় শুঁটকি নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। পাওয়া যাচ্ছে নানা মাছের শুঁটকি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৫ এপ্রিল। ছবি: প্রথম আলো

এই মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো চাল, ডাল, ধান ইত্যাদি পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি কেনাবেচা। প্রাচীন আমলের পণ্য বিনিময়প্রথা এ যুগেও আছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এ মেলায়।
স্থানীয় লোকজনের দাবি, এই ‘শুঁটকি মেলা’ প্রায় চার শ বছরের পুরোনো। মেলায় শুঁটকির পাশাপাশি গৃহস্থালি সামগ্রীসহ শিশুদের নানা ধরনের খেলনাও বিক্রি হয়। স্থানীয় কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত চাল, ডাল, ধান, শিমের বিচি, আলু, সরিষা, পেঁয়াজ ও রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি কিনে নেন। তবে নগদেও বিক্রি হয় এখন।

জানা গেছে, মেলার প্রথম দিনে ভোর ছয়টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত গ্রামের লোকজন ও দোকানিদের মধ্যে চলে এ পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বিনিময়ের প্রথা। স্থানীয় হিন্দু জনগোষ্ঠীর লোকজন নিজেদের উৎপাদিত শুঁটকি বিক্রি করেন। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শুঁটকি ব্যবসায়ীরাও শুঁটকি বিক্রি করতে এবং কিনতে মেলায় যান।

গ্রামের লোকজন জানান, বাংলা পঞ্জিকার নিয়মানুযায়ী নববর্ষের দ্বিতীয় দিনে হিন্দুদের পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর এই মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। স্থানীয় জেলেরা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই ব্যতিক্রমধর্মী এ মেলা করে থাকে। আজ সোমবার ও কাল মঙ্গলবার দুই দিনের এই মেলা বসেছে।
স্থানীয় লোকজনের তথ্যমতে, ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর মেলার আকর্ষণ অনেকটাই কমে গেছে। আগের মতো লোকজন মেলায় আর আসে না।
শুঁটকি বিক্রেতা মোহন লাল বলেন, এ বছর মেলায় উপজেলা প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকলেও নিরাপত্তা নিয়ে গ্রামবাসী সতর্ক ছিলেন।

মেলায় বিভিন্ন মাছের শুঁটকি কিনতে দূরদূরান্ত থেকে আসেন ক্রেতারা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৫ এপ্রিল। ছবি: প্রথম আলো
মেলায় বিভিন্ন মাছের শুঁটকি কিনতে দূরদূরান্ত থেকে আসেন ক্রেতারা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৫ এপ্রিল। ছবি: প্রথম আলো

গ্রামবাসী ও মেলায় আসা একাধিক ব্যক্তি জানান, কবে মেলার প্রথম আয়োজন তা জানা না গেলেও প্রতিবছরই এই মেলা বসে। কেউ কেউ বলেন, দুই শ বছরের পুরোনো। আবার কারও কারও ধারণা, পাঁচ শ বছরের পুরোনো এই মেলা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শুঁটকি ব্যবসায়ী ছাড়াও ভোজনরসিকেরা আসেন এ মেলায়।

এ গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব মোল্লা (৮০) বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা এ মেলা নিয়ে অনেক গল্পকাহিনি বলে গেছেন। সঠিক ইতিহাস কেউ বলতে পারবে না। তবে আমাদের ধারণা, এ মেলা ন্যূনতম চার শ বছরের পুরোনো।’
উপজেলা সদরের মৎস্য ব্যবসায়ী তপন দাস বলেন, ‘ছোটবেলায় বাপ-দাদার সঙ্গে সব সময় এ মেলায় এসেছি। শুনেছি তারও বহু আগে থেকে এ মেলা চলছে।’

মেলায় কথা হয় নাসিরনগর সরকারি কলেজের শিক্ষক জামিল ফোরকানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি মেলা থেকে শুঁটকি কিনে আমার নিজ জেলা কুষ্টিয়ায় পাঠাব। এ মেলায় দেশীয় সব জাতের শুঁটকি পাওয়া যায়। তাই মেলায় শুঁটকি কিনতে এসেছি।’

সিলেট থেকে আসা শুঁটকি ব্যবসায়ী নির্মল দাস বলেন, ‘আমি এ মেলায় ২০ বছর ধইরা হুটকি (শুঁটকি) নিয়া আসি। বাপ–দাদা আইত, তাই আমিও আইছি।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই শুঁটকি মেলা ইজারা মুক্ত হলেও স্থানীয় দালালদের টাকা দিয়ে দোকান নিতে হয়েছে।