কারখানার সংস্কারকাজ কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ফাইল ছবি
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ফাইল ছবি

রানা প্লাজা ধসের পর ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও দেশের রপ্তানিমুখী সব পোশাক কারখানা নিরাপদ করা যায়নি। উল্টো এক বছর ধরে কারখানার সংস্কারকাজ কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স চলে গেলেও অ্যাকর্ডের মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে টানাপোড়েন চলছে।

এদিকে জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনার (এনটিএপি) অধীনে থাকা ৭৪৫ কারখানার সংস্কারকাজ গত এক বছরে খুব একটা এগোয়নি। তার বাইরে ৬৫৪ কারখানাকে পরিদর্শন কার্যক্রমের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য না হওয়ায় এই কারখানাগুলোর দায়িত্ব নিচ্ছে না কেউ।

অবশ্য ব্যবসা হারানোর ভয় থাকায় ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের অধীনে থাকা দুই হাজার বড় ও মাঝারি কারখানার সংস্কারকাজ প্রায় শেষের দিকে। কারখানার কর্মপরিবেশের এই উন্নতিকে পুঁজি করে গত ছয় বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৯১০ কোটি মার্কিন ডলার বা ৭৭ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। গত অর্থবছরে ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। ২০১২-১৩ অর্থবছরে যা ছিল ২ হাজার ১৫১ কোটি ডলার।

ছয় বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল পৌনে নয়টায় সাভারে নয়তলা ভবন রানা প্লাজা ধসে পড়ে। এ ঘটনায় ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক মারা যান। আহত হন সহস্রাধিক শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে অঙ্গ হারান ২৭ জন।

রানা প্লাজায় পাঁচটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি পোশাক কারখানা ছিল। বর্তমানে সংস্কারকাজে পিছিয়ে থাকা কারখানাগুলোও ক্ষুদ্র ও মাঝারি। এসব কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ছাড়া পোশাকশিল্প নিরাপদ হবে না বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি দেখলে মনে হয় কারখানা পরিদর্শনের উদ্যোগহীনতার কালো অংশ বাড়ছে। এই অন্ধকার দূর করার জন্য সুস্পষ্ট উদ্যোগ দরকার।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কারা ইচ্ছাকৃত এবং কারা অনিচ্ছাকৃতভাবে সংস্কারকাজ বিলম্ব করছে, সেই তালিকা আমরা শিগগিরই করব। যেসব কারখানা ইচ্ছাকৃতভাবে সংস্কারকাজ বিলম্ব করছে, তাদের আমরা সুরক্ষা দেব না।’ তিনি বলেন, সংস্কারকাজ শেষ করতে সব কারখানার মালিককে সচেতন হতে হবে। কারণ, কোনো একটি কারখানায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে পুরো শিল্পই ভুগবে।

অগ্রগতি মাত্র ৩৮ শতাংশ

এনটিএপির অধীনে প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ৫৪৯ পোশাক কারখানার পরিদর্শন ২০১৫ সালের নভেম্বরে শেষ করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)। এসব কারখানার কোনোটিই শতভাগ ত্রুটিমুক্ত নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেড় হাজার কারখানার মধ্যে বর্তমানে ৬৯৭ কারখানা তদারকি করছে আইএলওর নেতৃত্বে ও ডিআইএফইর তত্ত্বাবধানে গঠিত সংশোধন সমন্বয় সেল (আরসিসি)। গত বছর এপ্রিলে কারখানাগুলোর সংস্কারকাজ শেষ হয়েছিল ২৭ শতাংশ। এক বছর পরে সেটি বেড়ে ৩৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য ২১৯ কারখানা কোনো ধরনের সংস্কারকাজ করেনি। বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও তারা কাজ করেনি। গত সেপ্টেম্বরে কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ইউডি সুবিধা না দিতে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএকে চিঠি দেয় ডিআইএফই। তবে ব্যবস্থা না নিয়ে আরও সময় চায় মালিকদের দুই সংগঠন।

জানতে চাইলে ডিআইএফইর যুগ্ম মহাপরিদর্শক ফরিদ আহম্মেদ বলেন, সংস্কারকাজের শুরু থেকেই অগ্রগতি কম। কারখানার মালিকদের সদিচ্ছার অভাব, আর্থিক সমস্যাসহ নানা কারণে সংস্কারকাজ খুব বেশি এগোয়নি। পরিদর্শনের বাইরে থাকা কারখানার বিষয়ে তিনি বলেন, কারখানাগুলো পরিদর্শনের জন্য একটি প্রকল্প হলেও এখনো অনুমোদন হয়নি।

অ্যাকর্ড নিয়ে টানাপোড়েন

রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে পাঁচ বছরের জন্য অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স গঠিত হয়। গত জানুয়ারি পর্যন্ত ইউরোপীয় ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ডের সদস্য ১ হাজার ৬৮৮ কারখানার অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত ত্রুটির ৮৯ শতাংশ সংশোধন কাজ শেষ হয়েছে। অন্যদিকে উত্তর আমেরিকার ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্সের ৬৫২ কারখানার ত্রুটির ৯৪ শতাংশ সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। তবে অ্যাকর্ডের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন।

গত বছরের এপ্রিলে অ্যাকর্ডের কারখানার সংস্কারকাজের অগ্রগতি ছিল ৮৩ শতাংশ। গত এক বছরের ব্যবধানে সেটি মাত্র ৬ শতাংশ বেড়েছে। এ বিষয়ে বিজিএমইএর সদ্য বিদায়ী সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘অ্যাকর্ডের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় বেশ কয়েক মাস ধরে তাদের ফলোআপ পরিদর্শন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে। তবে আমাদের কারখানা মালিকেরা অনেক কাজ করে বসে আছেন। পরিদর্শন না করায় অগ্রগতির হার কম দেখাচ্ছে।’

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, ‘অ্যাকর্ডের বিষয়ে সমাধানে পৌঁছাতে আমরা শিগগিরই আলোচনায় বসব। আশা করছি, ১৯ মের মধ্যেই একটা সমাধান হবে।’