জৌলুশ হারিয়েছে বড় বাজার

>
  • খুলনার পাইকারি বাজার
  • শতবর্ষের বেশি পুরোনো পাইকারি বাজার থেকে ব্যবসা গুটাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা
  • ১০ বছরে ব্যবসা গুটিয়েছেন অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী
  • তেলের ব্যবসা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে গেছে
  • ৫০-৬০ জন আমদানিকারকের মধ্যে টিকে আছেন হাতে গোনা কয়েকজন
  • চালের আমদানিকারক ছিলেন ২০ থেকে ২৫ জন, সবাই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন

জৌলুশ হারিয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় খুলনা পাইকারি বাজারটি। ২০ বছর আগেও এ অঞ্চলের নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ভোগ্যপণ্য ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশই ছিল এ বাজারের দখলে। সেই অবস্থা এখন আর নেই। গত ১০ বছরে লোকসানের কারণে এ বাজার থেকে ব্যবসা গুটিয়েছেন অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী।

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮৪২ সালে খুলনা মহকুমা তৈরি হয়। তার অনেক আগে থেকেই এ বাজারের গোড়াপত্তন। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদের পাড় ঘেঁষে ওয়েস্ট মেকড সড়ক, ভৈরব স্ট্র্যান্ড, হেলাতলা, কালীবাড়ি, কেডি ঘোষ ও স্যার ইকবাল সড়কের একাংশ ও খুলনার পুরোনো রেলস্টেশন–সংলগ্ন কদমতলা এলাকা নিয়ে এ বাজারের বিস্তৃতি ঘটেছে।

প্রায় ৫০ বছর ধরে এ বাজারের বিভিন্ন দোকানে কাজ করেছেন মো. ইসমাইল সরদার। জানতে চাইলে তিনি বলেন, একসময় এ বাজার থেকে পণ্য কিনতে প্রতিদিন শত শত ব্যবসায়ী ভিড় করতেন। নদীর ঘাটে লেগে থাকত ট্রলারের সারি। কোটি কোটি টাকা দাদন খাটত। কিন্তু সবকিছুতেই এখন ভাটা।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে এই বাণিজ্যকেন্দ্রের জৌলুশহীন রূপ চোখে পড়ে। বাজারের প্রধান সড়কগুলো চলে গেছে অবৈধ দখলে। তাতে সড়কগুলো এতই সংকুচিত হয়ে পড়েছে যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িসহ বড় কোনো গাড়ি ঢোকার উপায়ই নেই। তার ওপর সড়কের বেহাল দশা। ফলে বাজারে ঢুকতেই ভোগান্তিতে পড়তে হয় ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে। সরেজমিনে দেখা যায়, বাজারের কালীবাড়ি অংশের সড়কের বেশির ভাগই ট্রাক, ঠেলাগাড়ি, ভ্যানের দখলে। ভৈরব পাড়ে ট্রলারের সংখ্যা হাতে গোনা। বাজারের মধ্যে কিছু দোকানে ক্রেতার দেখা মিললেও অধিকাংশ দোকানই ক্রেতাশূন্য।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বাজারের ৫০–৬০ জন আমদানিকারকের মধ্যে বর্তমানে কোনোমতে টিকে আছেন হাতে গোনা কয়েকজন। খুলনা শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও মুনীর আহমেদ বলেন, বড় বাজারে বর্তমানে একদমই ব্যবসা নেই। লোকসানের কারণে তিনি তাঁর চালের ব্যবসাও গুটিয়ে নিয়েছেন। তাঁর মতো আরও অনেকে এ ব্যবসা ছেড়েছেন।

মুনীর আহমেদ আরও বলেন, আগে খুলনায় শতাধিক হাসকিং মিল ছিল, যার মধ্যে ৯০-৯৫টি বন্ধ হয়ে গেছে। হাসকিং মিলের জায়গা দখল করেছে অটোমেটিক চালকল। চালের পুরো বাজার চলে গেছে বাইরে। একসময় বড় বাজারেই শুধু চালের ২০ থেকে ২৫ জন আমদানিকারক ছিলেন, এখন তাঁদের সবাই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন।

বড় বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, ছোট–বড় মিলিয়ে এ বাজারে আড়াই হাজারের মতো দোকান আছে। ৬০টির মতো ব্যবসায়ী সমিতি আছে। এখন এ বাজারের বড় ক্রেতা খুলনার বিভিন্ন উপজেলা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা ও নড়াইলের মাঝারি ও ছোট পাইকারেরা। তাঁরাই মূলত টিকিয়ে রেখেছেন বড় বাজারের ব্যবসা।

এ বাজারের ব্যবসার জৌলুশ হারানোর জন্য বেশ কিছু কারণ তুলে ধরেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে খুলনায় বড় কোনো শিল্পকারখানা না থাকা, ভোগ্যপণ্যের বাজার ঢাকা ও চট্টগ্রামনির্ভর হয়ে যাওয়া, নৌপথের ব্যবহার কমে যাওয়া, আশপাশের জেলায় বড় বড় পাইকারি বাজার গড়ে ওঠা, শ্রমিকের মজুরি আশপাশের এলাকার চেয়ে কম এবং বড় কোম্পানিগুলো খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে পণ্য পৌঁছে দেওয়া।

বড় বাজার সাধারণ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শ্যামল হালদার বলেন, একসময় খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল বিভাগের পণ্য সরবরাহ হতো এ বাজার থেকে। এখন তারা আর এ বাজারে আসেন না। খুলনার আশপাশের জেলায়ও ভালো মোকাম গড়ে উঠেছে। ফলে ধীরে ধীরে জৌলুশ হারিয়েছে এ বাজার।

৩৫ বছর ধরে এ বাজারে ডালের ব্যবসা করছেন সাহা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী স্বপন সাহা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুলনার ডাল ব্যবসায়ীরা এখন প্রায় দেউলিয়া। আট-নয় বছর ধরে ব্যবসা একবারেই মন্দা।

ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার সাহা বলেন, ১০ বছরের ব্যবধানে তেলের ব্যবসা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে গেছে।

পদ্মা সেতু হলে খুলনা বড় বাজারের ভাগ্য খুলবে কি না, এমন প্রশ্নে ব্যবসায়ীরা দিলেন দ্বিধাবিভক্ত মত। একদল মনে করছে, খুলনার ব্যবসা আগে থেকেই ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। সেই ব্যবসা নতুন করে ফেরার সম্ভাবনা কম। তার ওপর পদ্মা সেতু হলে দক্ষিণের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ আরও সহজ হয়ে যাবে। তাতে বড় বাজারের গুরুত্ব আরও কমবে। ব্যবসায়ীদের আরেকটি অংশ মনে করে, পদ্মা সেতুর কারণে খুলনার আশপাশে কিছু শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে পারে। তাতে এ বাজারের ভাগ্য বদলানোর সম্ভাবনা রয়েছে।