অর্থ দিয়ে সুখ কেনা যায়?

টাকাপয়সা, সম্পদ নিয়ে আপনার ভাবনা কেমন? এই অর্থই কি জীবনের সব সুখ এনে দিতে পারে? বিপুল সম্পদের মালিক হলেই কি সব সুখ মেলে? নাকি অন্য কিছুর প্রয়োজন আছে জীবনে? অর্থ ক্ষণিকের সুখ দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু সব সময় সবকিছু অর্থ দিয়ে বিবেচনা করা কি সম্ভব? আসলে এর সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই।

গবেষকেরা মনে করেন, আমরা কীভাবে আমাদের অর্থ ব্যয় করব বা করছি, তা সুখের ধারণার ওপর একটা বড় প্রভাব ফেলে। মার্কিন লেখিকা গ্রেটচেন রুবিন তাঁর ‘দ্য হ্যাপিনেস প্রজেক্ট’ বইতে লিখেছেন, অর্থ সুখ কিনতে পারে না। তবে অর্থ ব্যয় করে আপনি যে অসংখ্য জিনিস কেনেন, তা আপনার সুখের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ও ‘হ্যাপি মানি: দ্য সায়েন্স অব স্মার্টার স্পেনডিং’ বইয়ের সহলেখক মাইকেল নরটনও অনেকটা এমনই ভাবেন। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘আসলে সুখকে পাশে রেখে আমরা অর্থ দিয়ে কিছু কিনি না। বরং আমরা আমাদের সুখকে পণ্যের মধ্যে স্থানান্তর করতেই অর্থ ব্যয় করি।’

অর্থ সুখ আনতে পারে, তবে এই অর্থনীতির ধারণায় সম্পদ সীমাবদ্ধ। বিভিন্নভাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে এই সম্পদের ভারসাম্য হয়। তাই সীমাবদ্ধ অর্থ দিয়ে কীভাবে সর্বোচ্চ আত্মিক শান্তি অর্জন করা সম্ভব? সম্প্রতি মার্কিন ফোর্বস ম্যাগাজিন এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কতগুলো পরামর্শ দিয়েছে।

অভিজ্ঞতা ক্রয়
ধরুন, আপনি ১০০০ টাকা ব্যয় করতে ইচ্ছুক। এ টাকা দিয়ে আপনি একটি ভালো সিনেমার টিকিট কিনতে পারেন, আবার একটা নতুন জামাও কিনতে পারেন। এখন এই দুটি জিনিসের মধ্যে কোনটা আপনাকে বেশি খুশি করবে? ধরে নেওয়া যাক, আপনার দুটোই পছন্দ। নরটন মনে করেন, অভিজ্ঞতা কেনা বিষয়টি নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। বিশেষ যে বিষয়টি উঠে এসেছে, তা হলো একই পরিমাণ অর্থ দিয়ে কোনো নতুন অভিজ্ঞতা কেনা কোনো বস্তু বা পণ্য কেনার চেয়ে বেশি আনন্দের। ওই অভিজ্ঞতা অন্য কারও সঙ্গে যত ভাগ করে নেওয়া যাবে, তত সুখ যোগ হবে।

মান শনাক্ত করুন
রুবিন বলছেন, আপনি যখন কোনো পণ্য কেনেন, তার দাম যদি আপনার ধরে নেওয়া মানের সঙ্গে মেলে, তাহলে আপনার সুখের অনুভূতি আসবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আপনি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে চান। আপনি একটি খাবার টেবিল কিনলেন, যা আপনাদের পারিবারিক সম্পর্ককে দৃঢ় করছে। অথবা ঘর গোছানোর পরে সাইড টেবিল রাখার একটি জায়গা খুঁজে পেলেন। যেটি কিনে আপনি আসলেই খুশি হলেন। অথবা একাকী কেবল নিজের সঙ্গে কিছুটা সময় ব্যয় করতে চান। তাঁর জন্য ভালো একটা মিউজিক সিস্টেম কিনলেন।

অন্যের জন্য ব্যয় করুন
নরটন মনে করেন, কেনাকাটায় পণ্যের মধ্যে পরিবর্তন আনার চেয়ে কার জন্য কিনছেন, সেই তালিকায় পরিবর্তন আনা যেতে পারে। একই অর্থ দিয়ে নিজের জন্য কিছু কেনার চেয়ে ওই অর্থ দিয়ে অন্যের জন্য কিছু কেনা অনেক সময় সুখের। অন্যের জন্য এই ব্যয় মনে সুখ আনে।

সঞ্চয়ই হচ্ছে বর্ম
টাকা জমানো মজার—এমনটা অপরিহার্য নয়। বর্তমান ভোগকে সরিয়ে রেখে টাকা জমিয়ে রাখার বিষয়টি খুব বেশি সুখকর নয়। তবে নরটন মনে করেন, সঞ্চয়ের অর্থ যখন হাতে থাকে, তখন তা মানুষকে সুখী করে তোলে। ঋণে জর্জরিত থাকা ভয়াবহ মানসিক কষ্টের বিষয়। আর তাই ঋণের ওষুধ বলা যেতে পারে সঞ্চয়কে। জীবনে বাড়তি সুখ যোগ করে সঞ্চিত টাকা।

কিনে কি সুখ পাব?
সব বাদ দিয়ে এটা মাথায় রাখতে হবে আমি যা কিনতে যাচ্ছি, সেটা পেলে কি আমি খুশি হব? বিশেষ করে অনলাইনে কিছু কেনার ক্ষেত্রে এটা মাথায় রাখতেই হবে। ধরুন, অনলাইনে কিছু কিনলেন, সেটি হাতে পাওয়ার আগে তা পেলে কেমন লাগবে সেই অনুভূতি লিখে রাখুন। কিছুদিন পর ওই লেখা থেকেই বুঝতে পারবেন ওর দাম আপনার কাছে কতটুকু।

ওপরের আলোচনা দিয়ে এতটুকু বলা যায় যে অর্থ ব্যয় করে কতটুকু সুখ কেনা যাবে, তা নির্ভর করে গ্রাহকের ওপরই। সে যদি তার অর্থ ব্যয় করে সুখ অনুভব করে তবে তা তার সুখই—এতে কোনো ভুল নেই। তবে ব্যয় যখন আমাদের ব্যক্তিত্ব, সামর্থ্যের সঙ্গে মানানসই হয় তখন অর্থ দিয়ে সুখ কেনা সম্ভব হয়—এমনটা মনে করেন যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। তাঁরা মনে করেন অর্থ দিয়ে কিছু কেনায় যে শান্তি আসে, তা আমাদের মানসিক চাহিদা পূরণ করে। যুক্তরাজ্যের ৭৭ হাজার ব্যাংক লেনদেন পর্যালোচনা করে এই গবেষণা করেছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও এই গবেষণার অন্যতম গবেষক জো গ্লাডস্টোন বলেন, এর আগে সব গবেষণায় সার্বিক সুখের সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক খুবই কম বলেই দেখা গেছে। কিন্তু আমাদের গবেষণা তা ভুল প্রমাণ করেছে। অর্থ থাকলে মনের মতো যেকোনো পণ্য ও সেবা ক্রয় করা যায়। এই বস্তুগত চাহিদা পূরণের মাধ্যমে মানসিক চাহিদা পূরণ হয় মন ও মেজাজ ভালো থাকে। শুধু তা–ই নয়, অর্থ আমাদের ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করে। সার্বিক সুখের জন্য তো এই সবকিছুই প্রয়োজন।

জো গ্লাডস্টোন তাঁর গবেষণায় পান, উপার্জন বা বিনিয়োগের পরিবর্তে অর্থের তাৎক্ষণিক সহজলভ্যতা জীবনে সন্তুষ্টি আনে।

একটা প্রবাদ আছে, ‘অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, ভালোবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়’। তাই সুখের জন্য আমাদের ঠিক কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, তা নির্ধারণেরও প্রয়োজন রয়েছে। বলা হয়, মোটামুটি ভালোভাবে চলার জন্য যা খরচ হয়, সেই ব্যয় মেটাতে পারলেই খুশি হয় মানুষ। তবে যে যেমন আয়ের ধাপে থাকে সে তেমনভাবে সুখী থাকে। যেমন নিম্নবিত্ত পরিবারের একজন সদস্য তাঁর আয়ের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য করে ফেলেন। ওই বেঞ্চমার্কের কম হলে তিনি কষ্ট পান। তাঁর বেশি পেলে সুখী ভাবেন। একই রকম মতাদর্শ প্রযোজ্য অন্য আয়ের গ্রুপের মানুষের জন্যও।

আসলে অর্থের সঙ্গে সুখের সম্পর্কটা বেশ জটিল। অনেকেই মনে করেন, বিত্তশালী ব্যক্তিরা হয়তো অসম্ভব বিলাসী জীবনযাপন করতে পেরে সুখী থাকেন। এ ধারণাকে পাল্টে দেন ওয়ারেন বাফেট। প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলারের মালিক এবং বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী বাফেট সাধারণ জীবনযাপন করতে ভালোবাসেন। সকালে খুব সাধারণ মানের নাশতা করেন তিনি। বিলাসী জীবনযাপন খুব একটা টানে না তাঁকে।

বাফেট বলেন, ‘১০ কোটি ডলার ব্যয় করে যে বাড়ি কিনব, সেই বাড়িতে থেকে আমি খুশি থাকব—এটা সত্যি। তবে ওই পুরোনো বাড়িতে থেকে আমি সবচেয়ে সুখী। যেখানে আমি ১৯৫৮ সাল থেকে থাকছি। কারণ এটাতে জড়িত সব স্মৃতি।’ কেনার সামর্থ্য থাকলেও স্মৃতিময় পুরোনো বাড়িই বাফেটের পছন্দ।

টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায় না। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় তরুণ কোটিপতি সুইডেনের মার্কাস পার্সসনের কথা। ভিডিও গেম মাইনক্রাফটের নির্মাতা মার্কাস একসময় অঢেল অর্থবিত্ত, সম্পদ থাকার পরও অশান্তিতে ছিলেন। জীবন নিয়ে বিরক্তি, একাকিত্ব আর একঘেয়েমি তাঁকে পেয়ে বসেছিল। নিজের একাকিত্ব সম্পর্কে মার্কাস বলেছিলেন, ‘স্পেনের ইবিজার সমুদ্রসৈকতে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি, বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে পার্টি করছি, মন যা চাইছে তাই করছি...অথচ এমন বিচ্ছিন্ন আর একাকী কখনোই বোধ করিনি।’

তাই বলা যেতে পারে, মানবজীবনে অর্থের সঙ্গে সুখের সম্পর্ক এক জটিল প্যারাডক্স—আপাতস্ববিরোধী।