ঋণখেলাপিদের মাফ নয়, শাস্তি দিন

অব্যাহত দরপতনে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা গতকাল সোমবার প্রতীকী অনশন করেছেন। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের একটি সংগঠন আছে। তাই তাঁরা বিক্ষোভ, মিছিল বা অনশন করে ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু ব্যাংক আমানতকারীদের কোনো সংগঠন নেই। থাকলে তাঁদেরও অনশন করা ছাড়া কোনো উপায় থাকত না। কারণ, ব্যাংকে রাখা আমানতকারীদের অর্থ যেভাবে ‘নয়-ছয়’ করা হচ্ছে, তাতে তাঁদের দুশ্চিন্তার অনেক কারণ আছে।

তবে সরকার আর ব্যাংকমালিকদের একটা ধন্যবাদ দেওয়াই যায়। কেননা, তাঁরা রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে ব্যাংক খাতের ‘নয়-ছয়’ করছেন। ব্যাংকের আসল মালিক গ্রাহকেরা, ৯০ শতাংশ মূলধন তাঁদের। আর তথাকথিত মালিকদের মূলধন বাকি মাত্র ১০ শতাংশ। অথচ তাঁদেরই দেওয়া হয়েছে ‘নয়-ছয়’ করার অধিকার।

এখন ‘নয়-ছয়’কারীদের মাফ করার কথা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। গত রোববার জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী এমনটাই বলেছেন।

১০ বছর পর গত জানুয়ারিতে দেশের অর্থমন্ত্রীর পদে পরিবর্তন এসেছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। ১০ জানুয়ারি ব্যাংকমালিক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক এই ঘোষণা দেন তিনি। কিন্তু এরপর খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে। এখন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ না করলে তবেই তা খেলাপি হবে, যা আগে ছিল তিন মাস। এতে অবশ্য খেলাপি ঋণ কমবে, ব্যাংকের মুনাফাও বাড়বে। তবে আগের ঋণ শ্রেণিবিন্যাস নীতিমালাটি ছিল আন্তর্জাতিক মানের। সেখান থেকে পিছিয়ে গেল বাংলাদেশ।

ব্যাংক খাতে সরকারের আরেকটি পদক্ষেপ হলো, ঋণখেলাপিরা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ শোধ করতে পারবেন। এ জন্য তাঁদের এককালীন ২ শতাংশ টাকা জমা দিতে হবে। এরপর ১২ বছরের মধ্যে বাকি টাকা শোধ করতে পারবেন। সর্বশেষ ঘোষণা এল, ঋণখেলাপিদের মাফ করে দেওয়া হবে। অন্যান্য দেশে নাকি ঋণখেলাপিদের মাফ করে দেওয়া হয়। তবে কোন দেশ খেলাপিদের মাফ করে, তা অবশ্য জানা গেল না। বরং জানা গেল, চীনে ঋণখেলাপিদের বিমানে ওঠায় নিষেধাজ্ঞা আছে, নেপালের মতো দেশে ঋণখেলাপিরা পাসপোর্ট সুবিধা পান না। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সরাসরি জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

অবশ্য এমন নয় যে ঋণখেলাপিদের এর আগে কখনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। কিন্তু সেই সুযোগ তাঁরা গ্রহণ করে ভালো হয়ে গেছেন এমন নজির নেই। ২০১৫ সালে ঋণখেলাপিদের জন্য ঋণ পুনর্গঠন নীতিমালা জারি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন ১১টি শিল্প গ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করে বড় ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়। আর সেই সুবিধা নেওয়ার পর দুটি গ্রুপ ছাড়া আর কেউ টাকা পরিশোধ করেনি। সুতরাং ভবিষ্যতেও খেলাপিরা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করবেন, এমন প্রত্যাশা সম্ভবত কেউই করেন না।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুরো এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে খেলাপি ঋণ বেশি আছে কেবল আফগানিস্তানে। সর্বশেষ হিসাবে অবলোপন করা ঋণসহ দেশের খেলাপি ঋণ হলো ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ ২০০৯ সালের শুরুতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।

ঋণখেলাপিদের মাফ করে দেওয়ার ঘোষণা যেদিন সংসদ থেকে এল, সেদিনই (রোববার) বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) আলোচনা সভায় ব্যাংক খাতের দুরবস্থা নিয়ে অনেক কথা হলো। ওই সভায় ব্যাংক খাত পিছিয়ে যাওয়ার তিনটি কারণ জানালেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। পরিচালনা পর্ষদের অযাচিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাংক খাত নিয়ন্ত্রণ, ঋণ পুনর্গঠনের শর্ত শিথিল করা এবং খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন—মোটা দাগে ব্যাংক খাতের দুরবস্থার এই তিনটি কারণ তুলে ধরলেন তিনি। আবার ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সভাপতি, ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেছিলেন, ঋণখেলাপিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তাহলে ঋণ নেওয়ার সময় ঋণগ্রহীতারা চিন্তা করবেন, টাকা ফেরত দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় এসব বক্তব্য নিয়ে কী বলবেন জানি না।

প্রশ্ন হচ্ছে, ঋণখেলাপিদের শাস্তি না দিয়ে মাফ করা হচ্ছে কেন। কেনইবা খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার বদল হলো। একশ্রেণির ব্যবসায়ীর চাপেই তা করা হচ্ছে বলে ইঙ্গিত দিলেন অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। আর ২৩ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশেষ একটি গোষ্ঠী সরকারকে করায়ত্ত করে নীতি নির্ধারণ করছে।

ব্যাংক খাতের সংকট এক দিনে তৈরি হয়নি। ফলে রাতারাতি তা কাটবে না। কিন্তু সংকট মোকাবিলায় সরকার আন্তরিক—এই বার্তা দেওয়া জরুরি। ঋণখেলাপিদের ক্রমাগত ছাড় দিয়ে এই বার্তা দেওয়া যাবে না; বরং মাফ নয়, শাস্তি দিন—এই বার্তা দেওয়াই বেশি জরুরি। জোর করে যেমন সুদহার নির্ধারণ করা যায় না, তেমনি বিশেষ গোষ্ঠীর পরামর্শেও ব্যাংক খাত ঠিক হবে না। এটা যত দ্রুত অনুধাবন করা যায় ততই মঙ্গল।