বাড়ছে মাছের ব্যবসা, বাড়ছে মানুষের সুখ

ময়মনসিংহে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা মৎস্য খামারে মাছ ধরছেন চাষিরা। সম্প্রতি জেলার গৌরীপুরের চন্দপাড়া গ্রামে।   প্রথম আলো
ময়মনসিংহে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা মৎস্য খামারে মাছ ধরছেন চাষিরা। সম্প্রতি জেলার গৌরীপুরের চন্দপাড়া গ্রামে। প্রথম আলো
>

• ময়মনসিংহের ব্যবসা-বাণিজ্য
• ১৩ উপজেলার সব কটিতেই বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ হচ্ছে
• বেশি চাষ হচ্ছে রুই, কাতলা, পাঙাশ, তেলাপিয়া, কই ও শিং জাতের মাছ

ঢাকা থেকে যাওয়ার পথে ময়মনসিংহ পৌঁছানোর আগেই মহাসড়কসংলগ্ন ত্রিশাল উপজেলা। এ উপজেলার মহাসড়ক সংযুক্ত বৈলর থেকে রাধাকানাই সড়কের দৈর্ঘ্য সাত কিলোমিটার। প্রায় পুরো সড়কের দুই পাশেই পুকুর। ১০ বছর আগে এর সবই ছিল ধানি জমি।

গত এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের একদিন বিকেলে গিয়ে দেখা গেল সারি সারি ট্রাক দাঁড়িয়ে। প্রথমে মনে হতে পারে ট্রাকস্ট্যান্ড। তবে কিছু দূর এগোতেই বোঝা গেল, মাছের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে ট্রাকগুলো। প্রতিটি ট্রাকেই পানিভর্তি ড্রাম।

সন্ধ্যার আগে আগে পুকুর থেকে মাছ তুলে সরাসরি রাখা হলো ট্রাকে থাকা ড্রামগুলোতে। এভাবেই এসব মাছ প্রতিদিন যায় রাজধানী ঢাকা ও সিলেটে। জীবিত হওয়ায় মাছের দামও ভালো। এ জন্য খুশি মাছচাষিরাও। ফলে এক দশক আগে শুরু হওয়া ময়মনসিংহের মাছ ব্যবসা এখনো প্রতিনিয়ত বাড়ছে, বাড়ছেন সুখী মাছচাষিও। বেকারত্বও কিছু কমেছে।

ময়মনসিংহের ১৩ উপজেলার সব কটিতেই বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি মাছ চাষ হচ্ছে ত্রিশাল, ভালুকা, তারাকান্দা ও মুক্তগাছায়। বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ হচ্ছে রুই, কাতলা, পাঙাশ, তেলাপিয়া, কই, মাগুর ও শিং জাতের মাছ। জেলায় পুকুরের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পৌনে দুই লাখে।

ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জেলায় মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৮৮২ মেট্রিক টন। আর মাছের চাহিদা ১ লাখ ১৬ হাজার ৩৫৮ মেট্রিক টন। ফলে প্রতিবছর তিন লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টনের বেশি মাছ সরবরাহ হচ্ছে এ জেলা থেকে। রাজধানীর দূরত্ব ১১০ কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ায় এসব মাছের ভোক্তা মূলত ঢাকাবাসী। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সারা দেশে মাছ উৎপাদিত হয়েছে ৪২ লাখ মেট্রিক টন। অর্থাৎ উৎপাদনের ১০ ভাগের এক ভাগ মাছ চাষ হচ্ছে এসব উপজেলায়।

ময়মনসিংহ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিত মাছচাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। তাঁদের সচেতন করা হচ্ছে, যাতে মাছকে ক্ষতিকর কোনো ওষুধ না খাওয়ানো হয়।’

ত্রিশাল উপজেলার ওই সড়ক ধানীখোলা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে। এতে রয়েছে পাঁচ শতাধিক খামার। ধানীখোলা ইউনিয়ন মানেই এখন পুকুরের ইউনিয়ন। শুরুতেই পাশাপাশি পাঁচটি বড় আকারের পুকুর। কথা হলো পুকুরের রক্ষক আবদুল হাকিমের সঙ্গে। তিনি জানান, পাঁচটির মধ্যে দুটি পুকুরে পোনা ছাড়া হয়েছে। পাঙাশের পোনা এসেছে সান্তাহার থেকে। বাকি মাছের পোনা স্থানীয়।

কিছু দূর এগিয়ে দেখা মিলল মাসুদ রানার সঙ্গে। তিনি লাইনে দাঁড়ানো ট্রাকগুলোকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। জানা গেল, এখন বেশির ভাগ চাষি
মাছ বড় হলেই পুরো পুকুর বিক্রি করে দেন। স্থানীয় বেশ কিছু মধ্যস্বত্বভোগী গড়ে উঠেছেন, যাঁরা এসব পুকুর কিনে পরবর্তী সময়ে মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন। এমন একজন মধ্যস্বত্বভোগীর প্রতিনিধি তিনি।

মাসুদ রানা জানান, এখন রুই মাছ ২২০ টাকা, কাতল ২৫০ টাকা, পাঙাশ ১১৮ টাকা, শিং ৪৫০ টাকা, মাগুর ৪০০ টাকায় প্রতি কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। জীবিত মাছ হওয়ায় খরচ একটু বেশি, পানি ও ড্রাম লাগে। আবার এক ট্রাকে বেশি মাছও নেওয়া যায় না।

এ এলাকার চাষি মো. তোফায়েল প্রথম আলোকে বলেন, মাছের দাম বাড়ছে। এখন সবাই ভালো আছে। গত শীতে অনেকের মাছ মারা গিয়েছিল। তখন অনেকেই পুঁজি হারায়। এ ইউনিয়নেরই মাছচাষি জসীম উদ্দিন। আট বছর ধরে তিনি মাছ চাষ করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাছের খাবারের দাম বেড়ে গেছে। ঠিকমতো পাওয়া যায় না।

এলাকায় মাছ চাষকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু মাছের খাদ্য মিল গড়ে উঠেছে। বড় আকারের মিলের মধ্যে চোখে পড়ল জননী অটো ফিশ ফিড মিল, প্রত্যয় অটো ফিড মিল।

জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এখন পুরো জেলায় পুকুরের সংখ্যা ১ লাখ ৭৫ হাজার ৭২৫, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যা ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার ৮৭৯টি। আর জেলায় মাছচাষির সংখ্যা ১ লাখ ১১ হাজার ৬৯৫। এর মধ্যে মাছের পোনা ব্যবসায়ী রয়েছেন সাড়ে তিন হাজার। বরফকল রয়েছে ৫৯টি।