'অবৈধ' ৩৫ কোটি টাকা এমডির ব্যাংক হিসাবে

এনসিসি ব্যাংকের এমডি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
এনসিসি ব্যাংকের এমডি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
>

• বিএফআইইউর বিশেষ অনুসন্ধান
• এমডি ও স্ত্রীর নামে অর্থের লেনদেন
• আয়ের উৎস খতিয়ে দেখতে চিঠি
• অপসারণে ব্যবস্থা নিতে প্রক্রিয়া শুরু

বেসরকারি ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স (এনসিসি) ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের ঋণগ্রহীতার টাকা ছাড়াও পরামর্শক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং শেয়ারবাজার থেকেও তাঁর হিসাবে টাকা জমা হয়েছে।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) বিশেষ অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মূলত বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্রোকারেজ হাউসে এমডির নিজের ও স্ত্রীর নামে এই অর্থের লেনদেন হয়েছে। ৫টি ব্যাংকে থাকা মোসলেহ উদ্দিনের হিসাব জব্দ করেছে বিএফআইইউ। ব্যাংকগুলো হলো এনসিসি, যমুনা, প্রাইম, সিটি ও প্রিমিয়ার। একই সঙ্গে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের হিসাবও জব্দ করেছে সংস্থাটি। বিশেষ অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বিএফআইইউ বলেছে, ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে থাকা অবস্থায় তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক হয়েছেন।

মোসলেহ উদ্দিন আহমেদের আয়ের উৎস ও সম্পদের বিষয়ে খতিয়ে দেখতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাঁকে অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

আইনগতভাবে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের বিষয়টি খতিয়ে দেখে বিএফআইইউ। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাই পরিচালনা করেন বিএফআইইউ। জানতে চাইলে বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান গতকাল রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, নগদ লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করতে গিয়ে তাঁর হিসাবে কিছু গরমিল মনে হয়েছে। আরও বিশদ তদন্তের জন্য তাঁর হিসাবগুলো জব্দ করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী, পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে বিভিন্ন সংস্থায় পাঠানো হচ্ছে।

মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ২০১৫ সাল পর্যন্ত যমুনা ব্যাংকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি এনসিসি ব্যাংকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) হিসেবে যোগ দেন। ২০১৭ সালের আগস্টে তিনি এনসিসি ব্যাংকের এমডির দায়িত্ব নেন।

মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ গতকাল রাতে এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩০ বছরের চাকরিজীবনে আমি অনেক দেশি-বিদেশি ব্যাংকে ছিলাম। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। একটা জমি বিক্রি করেছি ৪ কোটি টাকায়। আমার স্ত্রীও চাকরিজীবী। আমার ব্যাংক হিসাবে কোনো অবৈধ অর্থ জমা হয়নি। সব টাকার হিসাব আমি দিতে পারব।’ তাঁর দাবি, ‘আমি যেন কারও আক্রোশের শিকার না হই।’

কোন ব্যাংকে কত টাকা
বিএফআইইউর তদন্ত অনুযায়ী, ৫ ব্যাংক, ২ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ৪টি ব্রোকারেজ হাউসে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে এনসিসি ব্যাংক ভবন শাখায় তাঁর হিসাবে প্রতি মাসের বেতন বাবদ জমা হয় ৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮৪০ টাকা। তবে ওই শাখাতেই তিনি একটি বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব খোলেন, যাতে বিভিন্ন সময়ে জমা হয় ৫ হাজার ডলার। আর গত ৩১ জানুয়ারি জমা হয় ৮ হাজার ডলার।

২০১৫ সালের শেষে এনসিসি ব্যাংকে যোগদান করলেও তাঁর যমুনা ব্যাংকের হিসাবে নিয়মিত টাকা জমা হয়েছে। যমুনা ব্যাংকে নিজের নামে একটি ও স্ত্রী লুনা শারমিনের সঙ্গে যৌথ একটি হিসাব রয়েছে। এতে জমা হয়েছে যথাক্রমে ৬ কোটি ও সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এভাবে যমুনা ব্যাংকের হিসাবে সাড়ে ৯ কোটি টাকা জমা হয়েছে। এর মধ্যে যমুনা ও এনসিসি ব্যাংকের গ্রাহক ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং একাই দিয়েছে ৪ কোটি টাকা। এই টাকা জমা হয়েছে ২০১৮ সালের ৫,১২, ১৫ ও ২৫ এপ্রিল।

দি সিটি ব্যাংকে মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ, তাঁর স্ত্রী লুনা শারমিন ও তাঁদের যৌথ মিলে তিনটি হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবে বিভিন্ন সময়ে জমা হয়েছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। প্রাইম ব্যাংকের ইসলামি ব্যাংকিং শাখায় তাঁর নামে থাকা হিসাবে জমা হয়েছে ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। প্রিমিয়ার ব্যাংকে থাকা হিসাবে জমা হয়েছে ২ কোটি ৮ লাখ টাকা।

এ ছাড়া রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে তাঁর নামে রয়েছে ৪ কোটি টাকা ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে ২ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত। পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে নিজের নামে ৪টি ব্রোকারেজ হাউসে হিসাব খুলেছেন মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ। এসব হিসাবে জমা রয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ব্রোকারেজ হাউসগুলো হলো সিটি ব্রোকারেজ, এনসিসি ব্যাংকের সিকিউরিটিজ, সিএসএমএল সিকিউরিটিজ ও ই-সিকিউরিটিজ।

কারা দিল এত টাকা
তদন্তে উঠে এসেছে, যমুনা ব্যাংকে থাকা মোসলেহ উদ্দিনের ব্যাংক হিসাবে নিয়মিত ভিত্তিতে টাকা জমা দিয়েছে গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসেই চার দফায় ১ কোটি করে ৪ কোটি টাকা জমা করেছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং। এ গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের কাছে যমুনা ও এনসিসি ব্যাংকের ঋণ রয়েছে।

আর সেই টাকার মধ্যে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে ৩ কোটি টাকা ও ১ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত হিসাব খোলেন মোসলেহ উদ্দিন। আবার ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়েও ২ কোটি টাকার আমানত হিসাব খুলেছেন তিনি। এর জোগানদাতা ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং।

ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পর্কে মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘চাকরিজীবনে কখনোই এই প্রতিষ্ঠান আমার গ্রাহক ছিল না। এনসিসি ব্যাংকে যোগদানের আগেই তারা সুদ মওকুফ সুবিধা নিয়ে টাকা পরিশোধ করে চলে যায়। তারা ঋণের জন্য এলেও দিইনি। তবে তাদের কাছে জমি বিক্রি করেছি। সেই ৪ কোটি টাকা দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা করেছি।’

তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর আশুলিয়ায় ৫১ লাখ টাকায় একটি জমি বিক্রি করেন তিনি। তবে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাছ থেকে গ্রহণ করেন ৪ কোটি টাকা।

তদন্ত অনুযায়ী, সিটি ব্যাংকে থাকা হিসাবে টাকা জমা করেছেন এনসিসি ব্যাংকেরই একজন কর্মকর্তা। ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনি ৪৫ লাখ টাকা জমা করেন, পরদিনই সেই টাকা উঠিয়ে নেন। পরে ওই টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনা হয়।

এনসিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নূরুন নেওয়াজ সেলিম গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোববার গভর্নরের সঙ্গে এ নিয়ে আমরা দেখা করেছি। আমরা জানিয়েছি, দোষী প্রমাণ হলে আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে নির্দোষ কাউকে যেন অপরাধী না বানানো হয়।’

আয়কর বিবরণীতে যা আছে
মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ গত বছরের ৩০ জুনভিত্তিক এনবিআরে দাখিল করা বিবরণীতে বলেছেন, তাঁর কাছে সব মিলে ২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা জমা আছে। এতে শুধু এনসিসি ব্যাংকের হিসাব জমা দিয়েছেন। উল্লেখ করেছেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৮ লাখ টাকা আয় করেছেন। আর অন্য কোনো ব্যাংকে থাকা টাকা বা শেয়ারবাজারের আয়ের হিসাব দাখিল করেননি।

বিএফআইইউ বলছে, আয়কর বিবরণীতে তিনি অসত্য তথ্য দিয়েছেন, যা অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন, ২০১২–এর ২ (শ) মোতাবেক ‘কর সংক্রান্ত অপরাধ’।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকের এমডিরা এখন নিয়মকানুন মেনে চলছেন না। পর্ষদের পরিচালকদের নির্দেশে চলতে হচ্ছে তাঁদের। তাঁরা সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থ দেখছেন না। এ কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে। যেটা পুরো ব্যাংক খাতের জন্য দুঃখজনক।

 আরও পড়ুন...