সন্দেহজনক লেনদেন বেশি হুন্ডি ও প্রতারণায়

দেশের আর্থিক খাতে অর্থের সন্দেহজনক বা অবৈধ লেনদেন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। আর্থিক খাতের এমন লেনদেন তদন্তের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছেই এমন তথ্য জমা পড়েছে। দেশের ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা, ব্রোকারেজ হাউস, জুয়েলারি, আবাসনসহ বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এসব তথ্য দিয়েছে। সংস্থাটি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের যে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

ঘুষ-দুর্নীতি, জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, মানব পাচার, চোরাচালান, মুদ্রা জাল করা থেকে যেকোনো অপরাধের মাধ্যমে অর্থ আয়, অর্থ পাচার ও বেআইনি কোনো লেনদেনকে সাধারণভাবে মানি লন্ডারিংয়ের আওতায় আনা হয়। কোনো সন্দেহজনক লেনদেন ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিএফআইইউতে রিপোর্ট করে। যাকে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) বলা হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫ হাজার ৪২২টি সন্দেহজনক বা অবৈধ লেনদেন হয়েছে। যাতে জড়িত ছিল ৯২১ কোটি টাকা। আর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এমন লেনদেন হয়েছিল ৩ হাজার ৭৩৬টি, যাতে জড়িত ছিল ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। এ হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ডিজিটাল হুন্ডিসংক্রান্ত। বছরজুড়ে সংস্থাটি ডিজিটাল হুন্ডি ঠেকাতেই ব্যস্ত ছিল, প্রতিবেদনটি পড়লে তা মনে হবে। এর ফলে প্রবাসী আয় বাড়তে শুরু করেছে বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে বিএফআইইউ।

বিএফআইইউর প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরে প্রবাসী আয় কমতে শুরু করে। আমাদের পরিদর্শনে আসে, বিদেশে বসে অ্যাপসের মাধ্যমে অর্থ পাঠানো হতো। কিন্তু দেশে কোনো ডলার আসত না। এ জন্য বিকাশের অনেক এজেন্টের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়, বিচারের জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিকট প্রতিবেদনগুলো পাঠানো হয়।’

তাহলে কি অবৈধ লেনদেন বেড়ে গেছে, এ নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে আগ্রহী হননি আবু হেনা রাজী হাসান। তিনি দাবি করেন, ‘সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এ জন্য তারা সময়মতো প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে। বিএফআইইউ গুণগত মান বিবেচনা করে তদন্ত করছে। এ সূত্র ধরে অবৈধ লেনদেন বেড়েছে না কমেছে, সেট বলা কঠিন।’

ব্যাংকে ১০ লাখ টাকার বেশি নগদ জমা হলে তাকে সিটিআর (নগদ লেনদেন প্রতিবেদন) হিসেবে বিএফআইইউতে প্রতিবেদন দিতে পারে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০ লাখ টাকার বেশি জমা হয়েছে, এমন ১ কোটি ৪৭ লাখ জমাকে সন্দেহ করেছেন ব্যাংকাররা। যাতে জড়িত টাকার পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৫২ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। একই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নগদে জমা হওয়া ৩১৫ কোটি টাকাকে সন্দেহ করছেন কর্মকর্তারা, যা জমা হয়েছিল ২ হাজার ৩৩০ বারে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের চেয়ে এমন সন্দেহের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ।

>

২০১৭-১৮ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ
বেশি সন্দেহজনক লেনদেন ডিজিটাল হুন্ডিসংক্রান্ত

এমন সিটিআর সবচেয়ে বেশি হয়েছে সীমান্তবর্তী জেলা যশোর, নওগাঁ, দিনাজপুর, সাতক্ষীরায়। এতে বলা হয়েছে, দুর্নীতি, মাদক ও মানব পাচারের অর্থ এসব হিসাবে লেনদেন হতে পারে। তবে এ নিয়ে কোনো তদন্ত করেছে কি না, তা প্রকাশ করেনি সংস্থাটি।

 ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিএফআইইউতে তথ্য চেয়ে ৫৫৩টি আবেদন ও অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ ২২৬টি আবেদন বা অভিযোগ করেছিল, যাতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পুলিশ এমন আবেদন করেছিল ১০৯টি ও আগের অর্থবছরে ৫০টি। এ ছাড়া গত অর্থবছরে দুর্নীতি দমন কমিশন ১৮৬টি, সাধারণ জনগণ ৩৪টি, বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ধরে ২৯টি ও অন্যান্য বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ৭৮টি অভিযোগ ও আবেদন জমা পড়ে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে তদন্ত প্রতিবেদন ও সন্দেহজনক লেনদেনের ৬৭৭টি প্রতিবেদন বিভিন্ন সংস্থায় পাঠায় বিএফআইইউ। এর মধ্যে ডিজিটাল হুন্ডিসংক্রান্ত লেনদেন ছিল ৬০৯টি। এ ছাড়া প্রতারণার ২৫, সন্ত্রাসে অর্থায়নসংক্রান্ত ২১, অর্থ জালিয়াতির ৪, দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের ৩, মাদক ও নেশায় অর্থায়নসংক্রান্ত ৮টি লেনদেনের তথ্য বিচারের জন্য বিভিন্ন সংস্থায় পাঠায় বিএফআইইউ। এগুলো যায় দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগে ব্যাংকগুলো তথ্য দিত না, ধরাও পড়ত না। এটা ভালো যে, তারা তথ্য দিচ্ছে। এখন উচিত হবে কোনো অপরাধ পাওয়ার পর যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা। এ জন্য সব সংস্থাকেই যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।