কোন-বা পথে যাবে নিতাইগঞ্জ?

‘কোন-বা পথে নিতাইগঞ্জ যাই’—জনপ্রিয় লোকগানের কথাটি একসময় যেন নারায়ণগঞ্জের পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র নিতাইগঞ্জের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। কারণ, ৬৪ জেলার বাংলাদেশের ৪০ জেলায় মালামাল যেত এই নিতাইগঞ্জ থেকে। যে বাজারে দৈনিক ২০০ কোটি টাকা লেনদেন হতো, সেখানে কোন পথে পৌঁছানো যায়, তা তো চিন্তার বিষয় ছিল বটে!

কিন্তু নিতাইগঞ্জ এখন নিজেই পথহারা। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো এই বাজারের ব্যবসায়ীরা দৈন্যদশায় আছেন। বড় পুঁজির সঙ্গে পেরে উঠছেন না তাঁরা। দৈনিক লেনদেন নেমে গেছে ১০০ কোটি টাকার নিচে। নিতাইগঞ্জ এখন নিজেই এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছে। শঙ্কা—কত দিন টিকে থাকতে পারবে নিতাইগঞ্জ?

এখানকার ব্যবসায়ীদের মতে, করপোরেট প্রতিষ্ঠান বা বড় কোম্পানিগুলো এখন চাল, ডাল, লবণ, চিনি, তেল, ময়দার মতো ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় চলে এসেছে। তারা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ব্যবসায়ীদের দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দিচ্ছে। একসঙ্গে অনেক পণ্য এক খরচে চলে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের আর মোকামে আসতে হচ্ছে না। আবার যেসব এলাকায় কৃষিপণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, সেসব এলাকায় মিলকারখানা গড়ে উঠেছে। অঞ্চলভিত্তিক বাজার তৈরি হয়েছে। যার ফলে আগে যেখানে নিতাইগঞ্জ থেকে ৪০ জেলায় মাল যেত, এখন তা নারায়ণগঞ্জের আশপাশের জেলা এবং সিলেট, ময়মনসিংহসহ ১০-১২ জেলায় সীমিত হয়ে পড়েছে।

রাজধানী ঢাকার অদূরে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে নারায়ণগঞ্জ শহরে পাইকারি বাজার নিতাইগঞ্জ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে পাট ও লবণ ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু গত শতাব্দীর ষাটের দশকের পর থেকে সেখানে ভোগ্যপণ্যের পাইকারি ব্যবসার বিস্তার শুরু হয়। একপর্যায়ে এটি দেশের তিনটি পাইকারি বাজারের একটি হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি বাজারের পরই নিতাইগঞ্জ। এটা লবণ, চিনি, চাল, ডাল, তেল, গম, আটা, ময়দা ও ভুসির জন্য প্রসিদ্ধ।

কিন্তু বছর তিনেক ধরে ক্রমাগত ব্যবসায়িক মন্দায় আছেন বলে জানালেন নারায়ণগঞ্জ আটা-ময়দা ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি শেখ ওয়াজেদ আলী। ময়দা ও ডাল ব্যবসায়ীরা বেশি বেকায়দায় পড়েছেন। এখানে ময়দার ছিল ৭০টি মিল, এখন ২২টি বন্ধ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেকগুলো বড় প্রতিষ্ঠান অত্যাধুনিক মিল বসিয়েছে। তারা গম আমদানি করে লাইটার জাহাজে এনে নিজেদের জেটিতে ভেড়ায়, অটোমেটিক মেশিনে জাহাজ থেকে মিলে তুলছে। বস্তাপ্রতি তাদের খরচ পড়ে তিন-চার টাকা। আর নিতাইগঞ্জে নদীর ঘাট থেকে শ্রমিকেরা মাথায় করে মাল তুলে আনেন। খরচ পড়ে অনেক বেশি।

মন্দা পরিস্থিতিতে পড়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন এখানকার পুরোনো ব্যবসায়ী ও নারায়ণগঞ্জ আটা-ময়দা ব্যবসায়ী সমিতির একসময়ের সভাপতি মঈন উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাহিদা কমে গেছে। যে ব্যবসায়ী আগে ২০০ বস্তা উৎপাদন করত, এখন ১০০ বস্তা করে। উৎপাদন কমলে গড়পড়তা খরচ বাড়ে। মিলে যে পরিমাণ মজুত, তাতে ঋণের টাকা শোধ করা যায় না। মিল না চললেও কর্মচারীর বেতন, ঘরভাড়া এসব তো দিতে হয়। যে শ্রমিক গদিতে কাজ করেন, দিন শেষে তাঁকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। লস দিয়ে আর কত দিন টিকে থাকব?’

ডাল ও লবণ মিলগুলোরও একই দশা। তিন-চার বছর ধরে তেল ও চিনির বিক্রিও কমেছে নিতাইগঞ্জ থেকে। যাঁরা উৎপাদনে যুক্ত নন, কেবল ট্রেডিং বা আড়তদারি ব্যবসা করেন, তাঁদের অবস্থা কিছুটা ভালো আছে। মেসার্স গরিবে নেওয়াজ সল্ট ইন্ডাস্ট্রির মালিক জামাল উদ্দিন দেওয়ানের মতে, যাঁরা উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে এনে পাইকারি বিক্রি করেন, তাঁদের অসুবিধা কম। তাঁরা ছোট-বড়, করপোরেট—সবার উৎপাদিত পণ্যই বিক্রি করেন।

শহরের যানজট কমানোর লক্ষ্যে দিনে ট্রাক চলাচল সীমিত করাতেও বিক্রি কমেছে বলে মনে করেন নিতাইগঞ্জের অনেক ব্যবসায়ী। তাঁদের দাবি, খালপাড়ে যে ট্রাকস্ট্যান্ড আছে, তাতে ৩০-৪০টির বেশি ট্রাক রাখা যায় না। আবার কোনো ট্রাক তিন ঘণ্টার বেশি রাখা যায় না। এখানে আসা বিভিন্ন এলাকার ছোট ব্যবসায়ীদের চার-পাঁচজন মিলে একটি ট্রাক ভাড়া করে মাল নিয়ে যান। এতে সময় লাগে। কিন্তু ট্রাক রাস্তায় দাঁড়াতে না পারায় সমস্যা হচ্ছে।

এখানকার বিভিন্ন ব্যবসায়ী সমিতির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখন নিতাইগঞ্জের ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ব্যবসায়ীর সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো। শুক্রবার বন্ধ থাকে। পবিত্র রমজান, দুই ঈদ ও দুর্গাপূজার আগে বিক্রি বাড়ে। রোজা শুরুর ১৫ দিন আগে ছোলা, মসুর ডাল, বুট, ডাবলি, তেল ও চিনি বিক্রি হয় বেশ। রোজার সাত দিন পর আবার এক দফা বিক্রি বাড়ে। ২০ রমজানের পর শুরু হয় ঈদের বিক্রি। ঈদুল আজহার সময় এখানে মূলত পশুখাদ্যের বিক্রি বাড়ে।

এখানে আগে থেকেই নগদ ও বাকি উভয় পদ্ধতিতে বেচা-বিক্রি হয়ে আসছে। এর মধ্যে বাকিতে বিক্রির পুরোনো ঐতিহ্য এখনো আছে। বাংলা বছরের শেষ দিন ৩০ চৈত্র সব বকেয়া পরিশোধ করতে হয়। এবারের হালখাতায় এখানে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা আদায় হয়েছে বলে জানালেন নারায়ণগঞ্জ সুগার অ্যান্ড অয়েল মিল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শংকর চন্দ্র সাহা। তিনি বলেন, ‘আগে শতভাগ কালেকশন (বকেয়া আদায়) হতো। এখন ৮০ ভাগ হয়।’

দেশের প্রায় সব ব্যাংকের শাখা আছে নিতাইগঞ্জে। চালের আড়ত আছে ১০০টির মতো, ময়দার মিল চালু আছে ৫০টি। ময়দার আড়ত ৬৮, গম ও ডালের আড়ত ২০০-২৫০, লবণের আড়ত আছে ৩০টি। তেল-চিনির আড়ত আছে প্রায় ৪০০। ভুসির আড়ত এক হাজারের মতো। প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। এর সঙ্গে যুক্ত আছে নদী ও সড়কপথে পরিবহন ব্যবসা, সেখানে বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান। এর একটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার আঁচ পড়ে সব কটিতে।

ব্যবসায়ী শেখ ওয়াজেদ আলী বললেন, ‘আগে আমরা সকাল সাত-আটটায় গদিঘর (ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান) খুলতাম। শেষ করতে করতে রাত ৯টা-১০টা বেজে যেত। এখন সকাল ১০টায় আসি। তিনটার মধ্যে বেচাবিক্রি শেষ।’ তিনি বলেন, ‘এটা শত বছরের পুরোনো বাজার। আমরা ছোট থেকে শুরু করেছি, বড় হতে পারিনি। তাই বলে মরে যাব?’

ব্যবসায়ীরা জানান, নিতাইগঞ্জে নদীর পাশে সরকার যদি কয়েকটি জেটি করে দেয় এবং মালামাল ওঠানো-নামানোর (লোডিং-অানলোডিং) আধুনিক ব্যবস্থা করে, তাহলে তাদের খরচ কমে আসবে। পাশাপাশি অটোমেটিক মেশিন কেনার জন্য স্বল্প সুদে ঋণ দিলে ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারবেন।

ব্যবসা কমলেও নিরাশ নন জয় ট্রেডার্সের মালিক শংকর চন্দ্র সাহা। তাঁর বাবা সুরেন্দ্র সাহা ব্রিটিশ আমলে এবং তারও আগে দাদা শরৎ চন্দ্র সাহা নিতাইগঞ্জে ব্যবসা করেছেন। শংকর সাহা ব্যবসায় আসেন ১৯৭৩ সালে। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ব্যবসার ধারা ও কৌশল যে পাল্টাতে হতে পারে, সেটা তাঁরা করতে পারেননি। এখন সবার দুশ্চিন্তা—তাহলে কি নিতাইগঞ্জ বিলুপ্ত হয়ে যাবে? শংকর চন্দ্র সাহা বললেন, ‘তাঁর বিশ্বাস, নিতাইগঞ্জ হারাবে না। সে নিজেই নিজের পথ ঠিক করে নেবে। যেভাবে পাটের জায়গায় এখন গার্মেন্টস এসেছে, এখানেও তেমন কোনো বিবর্তন হয়তো আসবে।’