লাভের আশা নেই, লোকসান বাড়ছেই

চিনি, পাটপণ্য, কাগজ, সুতা, কাপড় ও সিমেন্টের ব্যবসা করতে গিয়ে সরকারের লোকসানের বোঝা বছর বছর বাড়ছে। পাঁচটি সংস্থার অধীনে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোর সম্মিলিত লোকসান থেকে লাভ বাদ দিয়ে হিসাব করলে দেখা যায়, ১০ বছরে নিট ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে প্রায় ৬ গুণ হয়েছে।

২০০৮-০৯ অর্থবছরে এসব কারখানার লোকসান ছিল মাত্র ৩২৫ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে লোকসান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এসব কারখানার বড় অংশ ভবিষ্যতে লাভের মুখ দেখবে, এমন আশাও নেই। ফলে সরকারকে বছর বছর লোকসানের বোঝা বইতে হবে। ভর্তুকি দিতে হবে জনগণের করের টাকা থেকে। অথবা লোকসান কমাতে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।

এই পাঁচ সংস্থার মধ্যে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) ও বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি) পরিচালিত হয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি) রয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এসব মিল যখন হয়, তখন দেশের বেসরকারি খাত পিছিয়ে ছিল। এখন চিনি, পাটপণ্য, সিমেন্ট, কাগজ, সুতা ও বস্ত্রে বেসরকারি খাত এত এগিয়ে গেছে যে সরকারি কারখানা প্রতিযোগিতায় পারছে না।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত বেশির ভাগ কারখানা যেভাবে চলছে, সেভাবে চলতে দেওয়ার সুযোগ কম। এখন এগুলো নিয়ে ভালোভাবে চিন্তার সময় এসেছে। আগামী বছর এসব কারখানায় লোকসানের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, মিলগুলোর ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। এ জন্য পুনর্গঠন কৌশল ঠিক করতে একটি কমিটি গঠন করে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। পণ্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ অথবা কৃষকদের সহায়তা অন্য কোনোভাবে করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন তিন সংস্থা
বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ১২টি কারখানায় সার, কাগজ, সিমেন্ট, স্যানিটারি ওয়্যার ও গ্লাসশিট উৎপাদিত হয়। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুটি বাদে বাকি ১০ কারখানায় লোকসান দিয়েছে। কারখানাগুলোর মোট লোকসান দাঁড়িয়েছে ৬২২ কোটি টাকা। বিগত ১০ বছরের মধ্যে ৪ বছর কারখানাগুলো লাভে ছিল।

লোকসানের কারণ হিসেবে বিসিআইসি কারখানার বয়স, দক্ষ জনবলের অভাব, চলতি মূলধনের ঘাটতি, কারখানার সংস্কার, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন বা বিএমআরই না করা, বেতন বৃদ্ধি এবং উৎপাদন উপকরণ ও গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করেছে।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অধীনে থাকা ১৮টি কারখানার মধ্যে লাভে আছে মাত্র দুটি। এ দুটিতে আবার চিনি উৎপাদিত হয় না। চিনিকলের মধ্যে একটিও লাভে নেই। দেশে মোট চিনির চাহিদা ১৪ লাখ টনের বেশি। এর মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারি মিলগুলোতে উৎপাদিত হয় ৬৮ হাজার ৫৬২ টন চিনি, যা মোট চাহিদার ৫ শতাংশের নিচে। বিশ্ববাজারে চিনির দাম কম। সরকারি মিলগুলোকে সুরক্ষা দিতে চিনি আমদানিতে উচ্চ শুল্ক রেখেছে সরকার। যদিও বিএসএফআইসি দাবি করে, চিনির দর নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল টিকিয়ে রাখা দরকার।

লোকসানের কারণ হিসেবে বিএসএফআইসিও পুরোনো মিল, চলতি মূলধনের অভাব, আখের বিপরীতে চিনির দাম না বাড়ানো, আখের জাত ভালো না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছে। তারা উত্তরণের উপায় হিসেবে আখের জাত উন্নত করা, কারখানার বিএমআরই করা, চিনির দাম বাড়ানো, চিনি আমদানি ও বিপণনের কর্তৃত্ব তাদের হাতে দেওয়াসহ বিভিন্ন পথের কথা বলছে।

বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) অধীনে কারখানা আছে ১৩টি, যার চারটি বর্তমানে বন্ধ। সরকারের পাঁচটি সংস্থার মধ্যে এটিই কেবল লাভে আছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিএসইসির লাভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৭৬ কোটি টাকা।
বস্ত্র ও পাট শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা

বিজেএমসির অধীনে ২৫টি পাটকল রয়েছে। যার তিনটি নন-জুট। বাকি ২২টি পাটকল, যার সব কটিই লোকসানে রয়েছে। এসব পাটকলের মজুরি পরিশোধে প্রায় প্রতিবছরই সংকট তৈরি হয়। ফলে সরকারের কাছে হাত পাতে কর্তৃপক্ষ।
বিজেএমসির চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ নাছিম বলেন, কারখানাগুলোকে লাভে আনতে স্থায়ী শ্রমিকের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পুরোনো কারখানাগুলোর বিএমআরই করা দরকার। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা নিতে হবে। কাজ না করে মজুরি নেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করাও প্রয়োজন।

বিটিএমসির লোকসানের পরিমাণ অবশ্য কম এবং কমছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তাদের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা, যা আগের বছর ৮ কোটি টাকা ছিল। স্বাধীনতার পর ২০১০ সাল থেকে বিটিএমসির অধীনে থাকা ৫৮টি কারখানা অবসায়ন, হস্তান্তর ও বিক্রি করা হয়েছে। এখন সংস্থাটির অধীনে ২৫টি কারখানা রয়েছে, যা বিভিন্নভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

দায় নেই কারও
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, বেসরকারি খাতে লোকসান হলে তা ব্যবসায়ীর দায় হিসেবে থেকে যায়। সরকারি কারখানায় লোকসান হলে তার দায় কারও ওপর চাপে না। এ কারণে কারও মাথাব্যথা নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তিনি বলেন, এসব কারখানা ও ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে জনগণের করের টাকা দেওয়া হচ্ছে। সার কারখানাগুলো রেখে বাকিগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া দরকার।