রপ্তানির ৬০ ভাগই যায় ইউরোপে

দেশে যত রপ্তানিমুখী নিটওয়্যার (গেঞ্জি, টি-শার্ট) শিল্পকারখানা রয়েছে, তার ৬০ ভাগই নারায়ণগঞ্জে। এখান থেকে বছরে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার (৪০০ কোটি ডলার) রপ্তানি হয় বলে শিল্পমালিকেরা জানিয়েছেন।

দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতে নিটওয়্যার এবং ওভেনের (শার্ট-প্যান্ট) বাজার এখন প্রায় সমান সমান। সরকারি হিসাবে গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট নিটওয়্যার রপ্তানি হয় ১ হাজার ৫১৮ কোটি মার্কিন ডলার বা ১ লাখ ২১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকার। একই বছর ওভেন রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৫৪২ কোটি ডলার বা ১ লাখ ২৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকার।

রপ্তানি আয় তথা দেশের অর্থনীতিতে যাদের এমন ভূমিকা, তারা আছে নানামুখী সমস্যায়। নারায়ণগঞ্জে নিটওয়্যারের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র বিসিক শিল্পনগরী এলাকার রাস্তাঘাটের ভয়ংকর ভগ্নদশা। নর্দমাব্যবস্থা নেই বললেই চলে। পুরো এলাকা ময়লা-আবর্জনায় ভরা। যানবাহনের জট লেগে থাকে সারা দিন। বিদ্যুতের সমস্যা অনেকটা মিটলেও গ্যাসের চাপ কম। আছে পানিসংকট। নানা অজুহাতে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের চাঁদাবাজি তো রয়েছেই।

শতভাগ রপ্তানিমুখী এই শিল্পের যাত্রা শুরুই হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ থেকে গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। নব্বইয়ের দশকে এ শিল্প বিস্তার লাভ করে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, তাদের সদস্যভুক্ত রপ্তানিমুখী নিটওয়্যার শিল্পের সংখ্যা দেড় হাজার। এর ৬০ ভাগই নারায়ণগঞ্জে, বাকিগুলো গাজীপুর ও চট্টগ্রামে অবস্থিত। এর বাইরেও কিছু নিটওয়্যার কারখানা আছে, যারা বিজেএমইএর সদস্যভুক্ত।

বিকেএমইএর নেতারা জানান, শতভাগ রপ্তানিমুখী নিটওয়্যার পণ্য তৈরিতে যেসব উপাদান ব্যবহৃত হয়, তার প্রায় ৮০ ভাগই দেশীয় সামগ্রী। বাকিটা আমদানি করা সামগ্রী। আর ওভেনে (শার্ট-প্যান্ট) ৬০-৭০ ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ওভেনের পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্প (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) সেভাবে গড়ে ওঠেনি।

নিটওয়্যার রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ। দেশের উৎপাদিত নিটওয়্যারের প্রায় ৬০ ভাগই যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও চীনেও রপ্তানি হয়।

ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের ব্যবসা ছিল রমরমা, তখন নারায়ণগঞ্জকে স্কটল্যান্ডের বস্ত্র ও পাটকলসমৃদ্ধ ড্যান্ডি শহরের সঙ্গে তুলনা করে ‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’ বলা হতো। পাটের সেই দিন নেই। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ এখন দেশের নিটওয়্যার তৈরির রাজধানীতে পরিণত হয়েছে।

বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ নিটওয়্যারের সূতিকাগার। এর কারণ উদ্যোক্তা ও শ্রমিকদের পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। এখানকার শত বছরের পুরোনো হোসিয়ারি শিল্পের হাত ধরেই নিটওয়্যার শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এখন এখানে প্রায় আট লাখ শ্রমিক কাজ করেন। তিনি জানান, নিটওয়্যার শিল্পের পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে নিটিং ও ডায়িং কারখানা। প্রায় ৯০ ভাগ দেশীয় সুতা ব্যবহার করা হয় এখানে।

নারায়ণগঞ্জের নিটওয়্যারের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র বলা যায় পঞ্চবটী বিসিক শিল্পনগরীকে। মূলত হোসিয়ারিশিল্পের জন্য এটি করা হয়েছিল, কিন্তু তারা আসেনি। পরবর্তীকালে নিটওয়্যার শিল্পমালিকেরা এখানে কারখানা গড়ে তোলেন। বিসিক শিল্প মালিক সমবায় সমিতি সূত্রে জানা গেছে, এখানে নিটওয়্যার কারখানা আছে ৫০০, যা সারা দেশের মোট নিটওয়্যার শিল্পের এক-তৃতীয়াংশ। এর বাইরে ওভেন গার্মেন্টস, নিটিং, পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্প আছে এখানে।

বিসিক শিল্প মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, এখান থেকে বছরে ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। কাজ করেন প্রায় তিন লাখ শ্রমিক। অথচ এখানে সমস্যার অন্ত নেই। অবকাঠামোগত সমস্যা সবচেয়ে বড় সমস্যা। ময়লা ফেলার কোনো জায়গা নেই। রাস্তাগুলো ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা নেই। যেসব কারখানায় পানির সংযোগ আছে, তারা পানি পায় না, কিন্তু বিল দিতে হয়।

সরেজমিন বিসিক শিল্প এলাকা ঘুরে এর প্রমাণও পাওয়া গেল। ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। তাতেই চলছে পণ্যবাহী বড় বড় কাভার্ড ভ্যান বা ট্রাক। বেশির ভাগ রাস্তাই আবর্জনায় ভরা। নর্দমার পানি উপচে পড়ছে রাস্তায়। মানুষ পানি টপকে চলাফেরা করছে। যানজট তো আছেই। একজন বড় ব্যবসায়ী বলেন, যানজটের কারণে বিদেশি ক্রেতারা আসতে চান না। তাঁদের হেলিকপ্টারে করে আনতে হয়।

আর আছে চাঁদাবাজির অভিযোগ। তবে এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, প্রভাবশালী একটি গোষ্ঠীর হাতে ব্যবসায়ীরা জিম্মি। নানা অজুহাতে বড় বড় কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি করা হয়। তারপর ওই প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠ স্থানীয় বড় এক মাস্তান শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে আসেন মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করতে। বড় অঙ্কের টাকা না দিলে মীমাংসা হয় না। একই অবস্থা সিদ্ধিরগঞ্জের কারখানাগুলোতেও। সেখানে একই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অনুগত আরেক মাস্তান রাজত্ব করে। এসব নানা কারণে অনেক কারখানা এখান থেকে অন্যত্র চলে গেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে।

বিসিক শিল্পনগরী সিটি করপোরেশনের বাইরে। এটি এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের অধীন। ব্যবসায়ীদের হোল্ডিং ট্যাক্স দিতে হয় ইউনিয়ন পরিষদকে। কিন্তু প্লটপ্রতি কর ধার্য না করে পরিষদপ্রতি বর্গফুট অনুযায়ী হোল্ডিং কর নেয়। কর পরিশোধ না করলে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন হয় না। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ কোনো সেবা দেয় না। এমনকি ময়লা সরানোর কাজটাও করে না তারা।

এটা স্বীকারও করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানকার উন্নয়নকাজ করার দায়িত্ব বিসিকের। তবে ময়লা সরানোর বিষয়ে আমি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতির সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু ময়লা ফেলার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। একটা বড় জায়গা পেলে ময়লা নেওয়ার কাজটা ইউনিয়ন পরিষদ করবে।’ তবে কবে নাগাদ বড় জায়গা পাওয়া যাবে, তা তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।

এসব সমস্যা নিয়ে কথা হয় বিসিকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাঁদের দাবি, তাঁরা পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ পান না, তাই এসব সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না। পঞ্চবটী বিসিক শিল্পনগরীর এস্টেট কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সমস্যা আমরাও বুঝি, আমরা ওপরে লেখালেখি করছি। বরাদ্দ পাওয়া গেলে সমস্যার সমাধান করা যাবে।’ তিনি জানান, এ বছর তাঁরা ৬৮ লাখ টাকার মতো বরাদ্দ পেয়েছেন। এই টাকায় ৫৫০ ফুট ড্রেনের কাজ করা হয়েছে। ৩৮৬ ফুট রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে।

তবে বিসিক শিল্প মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বিসিক কর্তৃপক্ষ বলে বাজেট নেই। কিন্তু এখানকার শিল্পকারখানাগুলো যে সার্ভিস চার্জ দেয়, সেটার একটা অংশ ব্যয় করলেও এই করুণ দশা থাকে না। এ নিয়ে সমিতির পক্ষ থেকে বহু চিঠি দিয়েছি। সংসদীয় কমিটিতে বক্তব্য দিয়েছি, শিল্পসচিবকে বলেছি। কোনো কাজ হয়নি।’ এ রকম একটি রপ্তানিমুখী শিল্পপল্লির সমস্যা সমাধানে সরকারের উচ্চপর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন মোহাম্মদ হাতেম।

# আগামী পর্ব: দূষণে ধুঁকছে নারায়ণগঞ্জ