ভারতে রপ্তানি বাড়ছে লাফিয়ে

ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে সুদিন যাচ্ছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) দেশটিতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা। এতে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে শীর্ষ ১০ রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে নবম স্থানে চলে এসেছে নরেন্দ্র মোদির ভারত।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ভারতে ১০৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের আলোচ্য সময়ের চেয়ে ৫৩ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই রপ্তানি আয় গত অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি হয়েছে।

ইপিবির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, মূলত গত অর্থবছর থেকেই ভারতে রপ্তানি বাড়তে শুরু করে। গত অর্থবছর ভারতে রপ্তানি হয়েছিল ৮৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের পণ্য। তাতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল ২৯ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রপ্তানি আয় ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, কানাডার পরই বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির নবম শীর্ষ দেশ বর্তমানে ভারত।

অবশ্য শুধু রপ্তানি নয়, ভারত থেকে আমদানিও বাড়ছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ৮৬২ কোটি ডলারের পণ্য, যা আগের বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। ফলে আলোচ্য অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৭৫ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৪২ শতাংশ বেশি।

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভারতে পণ্য রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে সহায়তা করেছে তৈরি পোশাক, সয়াবিন তেল ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি। পোশাক রপ্তানি গত অর্থবছর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ৯ মাসের ব্যবধানে সয়াবিন তেলের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১০ কোটি ডলার। প্লাস্টিক পণ্য, ইস্পাত ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিও বাড়ছে। তবে পাট ও পাটের সুতা, মাছ ইত্যাদি পণ্যের রপ্তানি নিম্নমুখী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়। যদিও সেটা তেমন কাজে লাগাতে পারছিল না বাংলাদেশ। ২০১১ সালের দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সে জন্য বেশ কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়ে। কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরে পোশাকের নামীদামি বিদেশি অনেক ব্র্যান্ড বিক্রয়কেন্দ্র খোলায় তাতে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।

গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ১২ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেন। পরের অর্থবছর পোশাক রপ্তানি প্রায় ১১৫ শতাংশ বেড়ে ২৭ কোটি ৮৬ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ৪০ কোটি ১১ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। অর্থবছর শেষ না হলেও এখন পর্যন্ত পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি আছে ৪৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ভারতের বাজারে নিট পোশাকের চেয়ে ওভেন পোশাকই বেশি রপ্তানি হয়।

>এই প্রথম দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আয় ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে
ভারত এখন বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির নবম শীর্ষ দেশ

ভারতের বাজারে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতে দীর্ঘদিন ধরেই আমরা পোশাক রপ্তানি করি। তবে কিছু অশুল্ক বাধার কারণে পোশাক রপ্তানি সেই হারে বাড়ছিল না। তবে দুই অর্থবছর ধরে পোশাকের রপ্তানি বাড়ছে। এটি অবশ্যই ভালো লক্ষণ।’

রুবানা হক আরও বলেন, ‘১৩০ কোটির বেশি মানুষের দেশ ভারতের বাজারটি অনেক বড়। এই বাজারে আমাদের রপ্তানি বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে। তাই ভারতের বাজারে আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণ ঘটলেই ইউরোপের বাজারে আমরা অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হব। তখন আমাদের সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ব্যবসা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে সার্কভুক্ত দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে পারলে রপ্তানি দ্রুত বাড়বে।’

জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি অনেক ব্র্যান্ড ভারতে বিক্রয়কেন্দ্র খুলছে। তাদের অধিকাংশের সঙ্গেই বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছেন। তা ছাড়া ভারতের যাঁরা কাপড় উৎপাদন ও বাংলাদেশে তা সরবরাহ করেন, তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে পোশাক, বিশেষ করে শার্ট তৈরি করে নিচ্ছেন। এসব কারণে রপ্তানি বাড়ছে ভারতে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত বেশ ভালো পরিমাণে রপ্তানি হয়েছে সয়াবিন তেল। ইপিবির হিসাব অনুযায়ী আলোচ্য সময়ে ১৩ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের সয়াবিন তেল রপ্তানি হয়। অবশ্য এখন সয়াবিন তেল রপ্তানি বন্ধ বলে জানিয়েছে কোম্পানিগুলো। তারা বলছে, শুল্কমুক্ত তেল রপ্তানির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের শর্ত দিয়ে রেখেছে ভারত সরকার। বাংলাদেশি রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলো সয়াবিন তেলে ওই পরিমাণ মূল্য সংযোজনের দাবি করলেও ভারত সরকার এখনো তা আমলে নেয়নি। ফলে বিষয়টির কোনো সুরাহা না হওয়ায় আপাতত সয়াবিন তেল রপ্তানি বন্ধ রয়েছে বলে রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলো জানিয়েছে।

জানতে চাইলে ভারতের বাজারে তেল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘ভারতে সয়াবিন তেলের বাজার অনেক বড়। আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো সেখানে রপ্তানিতে ভালো করছিল। কিন্তু এখন শুল্ক-অশুল্ক বাধায় রপ্তানি বন্ধ।’