উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা চাই

>
মাহবুবুল আলম, চেয়ারম্যান, এম আলম গ্রুপ
মাহবুবুল আলম, চেয়ারম্যান, এম আলম গ্রুপ

১১৩ বছরের ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির টানা চতুর্থবারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন এম আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম। সভাপতি হিসেবে কর্মপরিকল্পনা, আসন্ন বাজেট ও চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ মিলাদ, চট্টগ্রাম

প্রথম আলো: ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে জুনে। ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে কেমন বাজেট প্রত্যাশা করছেন?

মাহবুবুল আলম: তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের এবার প্রথম বাজেট। ব্যবসায়ী হিসেবে অবশ্যই ব্যবসাবান্ধব, কৃষিবান্ধব ও শিল্পবান্ধব বাজেট চাই। এখন অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজ চলছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এক লাখ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যাতে অব্যাহত থাকে, সে ব্যাপারে বাজেটে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেখতে চাই। এর বাইরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক আট লেনে উন্নীত করা ও নতুন এক্সপ্রেস লাইন নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম ডেমু ট্রেনলাইন ও কনটেইনার রেললাইন চালু করার বিষয়ে বাজেটে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেখতে চাই।

প্রথম আলো: সাত মাস ধরে বন্দরের সেবার মান বেড়েছে। তবে পণ্য পরিবহন যেভাবে বাড়ছে, তাতে সেবার মান ধরে রাখা নিয়ে সংশয় আছে। বন্দর নিয়ে আপনাদের প্রত্যাশা কী?

মাহবুবুল আলম: ২০১৭ সালে যখন বন্দরের সেবার মান কমে গিয়েছিল, তখন চেম্বার থেকে আমরা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলাম। বন্দরে নতুন জেটি নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বে-টার্মিনাল নির্মাণের আবেদন জানিয়েছিলাম। এরপরই বন্দরে গ্যান্ট্রি ক্রেন যুক্ত হয়েছে। বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রক্রিয়া এগিয়ে যাচ্ছে। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে। আমাদের কথা হলো, বে-টার্মিনাল ও মাতারবাড়ীতে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা গেলে আগামী ১০০ বছর বন্দর নিয়ে ভাবতে হবে না। এখন চলমান প্রকল্পগুলো যদি বাস্তবায়নে দেরি হয়, তাহলে কিন্তু আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ জন্য আমাদের দাবি হলো বন্দরকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পদক্ষেপ নেওয়া।

প্রথম আলো: ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের দুঃখ এখন কী?

মাহবুবুল আলম: বর্তমানে এই এলাকার ব্যবসায়ীদের জন্য প্রথম দুঃখ ‘১৩ টন’। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ির ওজনসীমার নতুন বিধির কারণে ছয় চাকার ট্রাকে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহন করা যায় না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ওজনসীমার বাধ্যবাধকতা কঠোরভাবে অনুসরণ করা হলেও দেশের অন্য মহাসড়কে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। ফলে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেকে ব্যবসা হারিয়েছেন। চট্টগ্রামের সব ব্যবসায়ী বা শিল্পকারখানার উদ্যোক্তারা এই নিয়মের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। চট্টগ্রাম থেকে দেশের নানা স্থানে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে।

এ ছাড়া দ্বিতীয় বড় সমস্যা হলো উদ্ভিদ ও উদ্ভিদজাত পণ্য আমদানির অনুমতিপত্র সংগ্রহ। এই অনুমতিপত্র সংগ্রহে সাত-আট দিন সময় লাগছে। অথচ এক দিনেই আমদানির অনুমতিপত্র দেওয়ার কথা কৃষি বিভাগের। বিষয়টি নিয়ে কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা যাতে চট্টগ্রাম থেকেই আমদানির অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

এ ছাড়া জলাবদ্ধতা নিয়ে অনেক দিন ধরে দুর্ভোগে আছে নগরবাসী। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যও ব্যাহত হয়। সরকার যেহেতু জলাবদ্ধতা নিরসনে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়েছে, সে জন্য আমরা আশাবাদী। এখন চাইব, সঠিক সময়ে যথাযথভাবে যাতে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়।

প্রথম আলো: এলএনজি সরবরাহ শুরু হওয়ার পর চট্টগ্রামে গ্যাসভিত্তিক শিল্পকারখানা চালুর ক্ষেত্রে সমস্যা নিরসন হয়েছে কি?

মাহবুবুল আলম: চট্টগ্রামের কিছুসংখ্যক শিল্পকারখানা গ্যাস-সংযোগ পেয়েছে। তবে অনেক কারখানা এখনো গ্যাস পাচ্ছে না। কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চট্টগ্রামের শিল্পকারখানায় গ্যাস-সংযোগ সহজ ও দ্রুততর করার জন্য। অথচ সেখানে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। কোম্পানির বোর্ডের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে হয়। অনেক উদ্যোক্তা, যাঁরা জমি কিনেছেন, যন্ত্রপাতি স্থাপন করেছেন, তাঁদের শিল্পকারখানায় দ্রুত গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার দাবি জানাই। এলএনজি চালু হওয়ার পর গ্যাস-সংযোগ পেতে কেন ব্যবসায়ীরা ভোগান্তির মধ্যে পড়বেন, তা বোধগম্য নয়।

প্রথম আলো: সম্প্রতি আপনি চতুর্থবারের মতো চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি হয়েছেন। এ মেয়াদে আপনার কর্মপরিকল্পনা কী?

মাহবুবুল আলম: এবার একটি বড় কাজে হাত দিতে চাই। দেশে শিল্পকারখানা বা করপোরেট হাউসগুলোর ব্যবস্থাপনা পদগুলোতে বর্তমানে চীন, ভারত, তাইওয়ানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দক্ষ কর্মীরা কাজ করছেন। দক্ষ মানবসম্পদের অভাবের কারণেই বিদেশিরা এ দেশে অনেক প্রতিষ্ঠানে বড় বড় পদ দখল করে আছেন। এতে তাঁদের বেতন-ভাতা বাবদ কম করে হলেও বছরে পাঁচ-ছয় বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। এ জন্য প্রয়োজন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে উদ্যোগ নেওয়া। চট্টগ্রাম চেম্বার থেকে এবার এ বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নেব। তাই একটি ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। এর বাইরেও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা আছে। এতে শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে পড়ানো হবে। তৃতীয়ত, ‘চেম্বার ইকোনমিক জোন’ নামে নতুন একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠন করা হবে। চট্টগ্রাম শহরের আশপাশে এই অঞ্চল গড়ে তোলা হবে, যাতে চেম্বারের সদস্যরা শিল্পকারখানা গড়ে তোলার সুযোগ পান।