বায়রা লাইফে দুর্নীতি, প্রশাসক নিয়োগ হচ্ছে

কত অনিয়ম-দুর্নীতি করতে পারে একটি বিমা কোম্পানি! নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) নিজেই এমন একটি কোম্পানির অনিয়ম-দুর্নীতি উদ্‌ঘাটনে কূল-কিনারা করতে পারছে না। গ্রাহক প্রিমিয়াম দিচ্ছেন, কিন্তু কোম্পানির হিসাবে টাকা জমা হচ্ছে না। মেয়াদ শেষে বিমা পলিসির টাকা পাচ্ছেন না গ্রাহকেরা। নতুন পলিসির অন্যতম অংশ তামাদি হয়ে যাচ্ছে। আইন লঙ্ঘন করে প্রতিবছর বাড়ছে ব্যবস্থাপনা ব্যয়। গ্রাহকদের ভালো বোনাস দিতে পারছে না কোম্পানিটি।

এখানেই শেষ নয়, কোম্পানিতে বাধ্যতামূলক ২ শতাংশ শেয়ার রক্ষণ করছেন না উদ্যোক্তা পরিচালকেরা। বেআইনিভাবে এতে চারজন উপদেষ্টা রয়েছেন। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ১৬ বছর পার হলেও কোম্পানিটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। প্রতিবছর অ্যাকচ্যুয়ারিয়াল মূল্যায়ন করার নিয়ম থাকলেও কোম্পানিটি তা করছে না এবং তা না করার দায়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা যে জরিমানা আরোপ করেছে, সেটিও পরিশোধ করছে না। কোম্পানিটিতে দীর্ঘ সময় ধরে কোনো মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাও (সিইও) নেই।

এই কাহিনি ২০০০ সালে লাইসেন্স পাওয়া বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির। কোম্পানিটির যাবতীয় অনিয়ম-দুর্নীতির এই চিত্র তুলে ধরে আইডিআরএ গত ২২ মে কোম্পানির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল বাশারকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছে। কেন প্রশাসক নিয়োগ করা হবে না এবং বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের কার্যক্রম কেন স্থগিত করা হবে না—নোটিশ পাওয়ার সাত কার্যদিবসের মধ্যে (আগামী রোববার) বায়রা লাইফকে তা জানাতে বলেছে আইডিআরএ।

আইডিআরএ বলেছে, অদক্ষ পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কারণে বায়রা লাইফে বিমা গ্রাহকদের স্বার্থ সংরক্ষণ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এতে তীব্র ভাবমূর্তি সংকটের সৃষ্টি হয়েছে গোটা বিমা খাতে। এ ছাড়া বিমা আইনের কমপক্ষে আটটি ধারা লঙ্ঘনের মাধ্যমে কোম্পানিটি একটি অকার্যকর বিমাকারী প্রতিষ্ঠানে হিসেবে পরিণত হয়েছে।

দাবি অপরিশোধিত, প্রিমিয়াম জমাহীন

আইডিআরএ দেখেছে, ২০১৮ সালে ২৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকার বিমা দাবির মধ্যে ৭ কোটি ৬৮ লাখ এবং ২০১৭ সালে ৩০ কোটি ২২ লাখ টাকার মধ্যে ১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে কোম্পানিটি। অর্থাৎ দুই বছরেই কোম্পানিটি ৪০ কোটি টাকার দাবি পরিশোধ করেনি।

নোয়াখালীর দত্তের হাটে সরেজমিন তদন্ত করে আইডিআরএ দেখেছে, পলিসি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও ৮৬১ গ্রাহক বিমা দাবির টাকা পাননি। ফলে বিমা কোম্পানিটির এজেন্টরা গ্রাহকদের ক্রোধের শিকার হচ্ছেন। গ্রাহকদের হাতে প্রিমিয়ামের রসিদ থাকলেও তা কোম্পানির হিসাবে জমা হয়নি।

আইডিআরএ কার্যালয়ে বিমা গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৮ হাজার ২৩৭টি পলিসির মধ্যে ১ হাজার ৬১০টি পলিসির দাবি নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলে কোম্পানিকে জানিয়ে আইডিআরএ বলেছে, এখনো নিষ্পত্তির বাকি ৬ হাজার ৬২৭টি পলিসির দাবি।

অস্বাভাবিক তামাদি পলিসি ও ব্যবস্থাপনা ব্যয়

বায়রা লাইফের চলমান ৪৯ হাজার ৭২৯টি পলিসির মধ্যে ১৫ হাজার ৮৬৯টি তামাদি হয়ে যাওয়াকে আইডিআরএ ‘অস্বাভাবিক’ বলে আখ্যায়িত করেছে।

পলিসিহোল্ডারদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে গত ১০ বছরে কোম্পানিটি ৪৭ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা খরচ করেছে, যার ৯০ শতাংশ (৪২ কোটি ২৯ লাখ টাকা) পলিসিহোল্ডারদের। অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা খরচ না হলে এই টাকা পলিসিহোল্ডারদের বোনাস দেওয়া যেত।

চার বছর আগেই আইডিআরএতে অনুষ্ঠিত শুনানি সভায় ব্যবস্থাপনা খরচ অনুমোদিত সীমার মধ্যে রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোম্পানিটি সেই কথা রাখেনি এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ এ বিষয়ে অবগত থাকলেও কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আইডিআরএ বলেছে, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ অদক্ষ।

পরিচালকদের শেয়ার ঘাটতি

বিমা আইন অনুযায়ী পরিচালকদের ২ শতাংশ শেয়ার থাকার বিধান থাকলেও ছয়জন পরিচালকের তা কম আছে। তাঁরা পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। আইনে না থাকলেও কোম্পানিতে চারজন উপদেষ্টা সদস্য রয়েছেন। ২০০০ সালে বিমা লাইসেন্স পাওয়ার তিন বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও কোম্পানিটি আজ পর্যন্ত তা করতে পারেনি।

আবার জীবন তহবিলের ৩০ শতাংশ সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগের দিক থেকেও কোম্পানিটি ব্যর্থ। এদিকে চেয়ারম্যান ও সিইও বিলাসবহুল লেক্সাস গাড়িতে চড়ছেন, যে গাড়ি কোম্পানির ব্যবসায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ছাড়া যথাসময়ে অ্যাকচ্যুয়ারিয়াল মূল্যায়ন না করায় সাড়ে চার কোটি টাকা জরিমানা আরোপ করা হলেও কোম্পানিটি তা পরিশোধ করেনি।

বায়রা লাইফের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল বাশার এবং চলতি দায়িত্বে থাকা সিইও ওমর ফারুক ভূঁইয়াকে তিন দিন চেষ্টা করেও ফোনে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে বিষয়বস্তু উল্লেখ করে খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো জবাব দেননি তাঁরা।

আইডিআরএর সদস্য গকুল চাঁদ দাস গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কারণ দর্শানোর নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হলে কোম্পানিটিতে প্রশাসক নিয়োগ করা হবে এবং প্রশাসকই পরের পদক্ষেপ নেবেন।