বছরে খরচ বাড়ছে ১ টাকা, দাম কমছে ৬ টাকা

ন্যায্যমূল্যে ধান ক্রয়ের দাবির মিছিলে মাথায় বস্তা নিয়ে অংশ নেন একজন। গতকাল গাইবান্ধা শহরে।  ছবি: প্রথম আলো
ন্যায্যমূল্যে ধান ক্রয়ের দাবির মিছিলে মাথায় বস্তা নিয়ে অংশ নেন একজন। গতকাল গাইবান্ধা শহরে। ছবি: প্রথম আলো

সিরাজগঞ্জ জেলা খাদ্যগুদামের সামনে জনা বিশেক কৃষকের ভিড়। সবার সঙ্গে একটি করে ভ্যান ও তার ভেতরে বস্তায় ভরা ধান। সময় তখন সকাল ১০ টা। গুদামের দায়িত্বে থাকা খাদ্য পরিদর্শক এলেন বেলা পৌনে ১১টায়। ধান নিয়ে আসা কৃষকেরা তাঁকে ঘিরে ধরলেন। দু–তিনজন কৃষক একসঙ্গে বললেন, ‘আপনাদের ধান দিতি পারলি খরচটা কোনোমতে উঠে। হাটে নিলে তো অর্ধেক দামও পাচ্ছি না।’ গুদামে ধান নিয়ে আসা কৃষক রহমান আলীর কাছে জানতে চাইলাম, প্রতি বিঘায় কত খরচ হয়েছে? ধান পাচ্ছেন কী পরিমাণে? দাম পাচ্ছেন কত টাকা। খরচ কী গত বছরের তুলনায় বেড়েছে?

এতগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে করাতে কিছুটা ভড়কে গেলেন রহমান আলী। সাদা শ্মশ্রুমণ্ডিত প্রবীণ কৃষক মো. ফোরকান বলতে শুরু করলেন, ‘এই হিসাব অত সহজ না। এই ধরেন গিয়া যদি আমি নিজের জমি নিজে চাষ করি, তা–হইলে হিসাব এক রকম। আর অন্যের জমি বর্গা নেই তা–হইলে খরচ আরও বেশি।’

রহমান আলী এবার মুখ খুললেন। বললেন, ‘আমাগের নিজের জমিতে চাষ করেছি ছয় বিঘা, আর বর্গা নিছি চার বিঘা। নিজের জমিতে লোকসান বিঘায় ছয় হাজার টাকা। আর বর্গার জমিতে লোকসান ১০ হাজার টাকা। সরকারি গুদামে ধান দিতি না পারলে লোকসান হবেই।’

গত বছরের চেয়ে খরচ কী বেড়েছে? মো. ফোরকান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক সোহেল রানাকে দেখিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওরে দিয়া এক বিঘা জমির ধান কাটাইছি সাড়ে তিন হাজার টাকায়। আর রোয়া গাড়াইতে (চারা রোপণ) খরচ পড়ছিল আড়াই হাজার টাকা। গত বছর ওরে দিয়াই রোয়া গাড়ানো আর ধান কাটাইছি। নিছিল সব মিলাইয়া চার হাজার টাকা।’ এবার জমিতে সেচের পানির খরচও ৫০০ টাকা বেড়ে গেছে। জানালেন আরেক কৃষক আবদুর রহমান।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ কৃষক সোলায়মান ইসলাম বলেন, এখন সেচের পানি দেওয়ার নিয়মও বদলে গেছে। সব সেচপাম্পের মালিক হচ্ছেন নেতারা। বীজ, রোপণ, সেচ, সার, কীটনাশক, ধান কাটার খরচ বাবদ বেশির ভাগ ধানই তাঁদের চলে যায়। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আমাগের নিজের শ্রম আর জমির ভাড়া তো বাদই দিলাম।’

খরচ বাড়ছে কেজিতে ১ টাকা, দাম কমছে ৬ টাকা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সিরাজগঞ্জ জেলার দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক হাবিবুল হক জানালেন, সিরাজগঞ্জ জেলায় ধানের উৎপাদন খরচ প্রতিবছরই বাড়ছে। শুরুতে খরচের যে হিসাব তাঁরা করেছিলেন, এবার ধান কাটার সময় মজুরির খরচ তার চেয়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ফলে কৃষকের আসলেই লোকসান হচ্ছে বলে তিনি স্বীকার করেন।

সিরাজগঞ্জে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ২৩ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে জানিয়ে হাবিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। যন্ত্র দিয়ে ধান কাটতে ও রোপণ করতে প্রতি বিঘায় বড়জোর দেড় থেকে দুই হাজার টাকা খরচ পড়বে। আর সেখানে কৃষিশ্রমিক দিয়ে করাতে পাঁচ–ছয় হাজার টাকা লেগে যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সারা দেশের জন্য করা গড় উৎপাদন খরচকে অবশ্য একটু রক্ষণশীলই বলা যায়। সংস্থাটির হিসাবে, গড়ে দেশে প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ১ টাকা করে বাড়ছে। চলতি ২০১৮–১৯ অর্থবছরে খরচ পড়েছে প্রায় ২৫ টাকা। ২০১৭–১৮ অর্থবছরে তা ছিল ২৪ টাকা আর ২০১৬–১৭ অর্থবছরে ছিল ২২ টাকা।

আবার বেশির ভাগ কৃষকই সরকারের কাছে ধান বেচতে পারেন না। তাই তাঁদের বাধ্য হয়ে ফড়িয়া ও চালকলের মালিকদের কাছে কম দামে ধান বিক্রি করতে হয়। সিরাজগঞ্জ জেলার চালকলের মালিক ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এ বছর সরকারের বাইরে প্রতি কেজি ধান বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৪ টাকায়। গত বছর তা ছিল ২৪ থেকে ২৬ টাকা। আর তার আগের বছর ২৮ থেকে ৩২ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ উৎপাদন খরচ বাড়ছে গড়ে ১ টাকা করে। আর কেজিপ্রতি দাম কমছে ৬ টাকা করে।

>

সিরাজগঞ্জে প্রতি কেজি ধান
কৃষি মজুরি ও সেচে খরচ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে
বিপাকে প্রায় ৫ লাখ কৃষক
বেশি ক্ষতি বর্গাচাষিদের

প্রায় ৫ লাখ কৃষক বিপাকে, বেশি লোকসান বর্গাচাষির
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবদুস সোবহান জানালেন, জেলায় এবার প্রায় ২৮ হাজার টন বোরোর চাল ও ৫ হাজার ৮৮১ টন ধান সংগ্রহ করা হবে। তাঁরা কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে দ্রুত ধান–চাল কেনা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে ৫ হাজার ৩৯৭ টন চাল ও ৬৯৯ টন ধান কেনা হয়ে গেছে।

সিরাজগঞ্জ খাদ্য অধিদপ্তর যত দ্রুত ধান–চাল কিনুক না কেন তাদের এই কেনা থেকে কৃষকদের কতজন লাভবান হচ্ছেন, তা অবশ্য পরিসংখ্যান দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় কৃষকের সংখ্যা ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ জন। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ কৃষক বর্গাচাষি। তাঁদের নিজের কোনো জমি নেই।

জেলার কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, জেলায় এ বছর এক বিঘা ধানের জমি বর্গা নিতে মালিককে দিতে হয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। এই বর্গাচাষিরা মূলত ধার করে জমি চাষের খরচ জোগাড় করে থাকেন। ফলে ধান ওঠার পরপরই তাঁরা হাটে তা বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। তাঁদের ধানের নিজস্ব গোলাও নেই। বড় ও মাঝারি কৃষকের নিজের জমির পাশাপাশি গোলাও আছে। ফলে তাঁদের পক্ষে ধান মজুত করে রাখা সম্ভব।

জেলা খাদ্যগুদাম থেকে বের হওয়ার সময় রিকশায় করে ধান নিয়ে আসছিলেন সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের সয়দাবাদ ইউনিয়নের কৃষক আবদুল মালেক। সরকারি গুদামের সামনে ধানের বস্তা নামাতে নামাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আর কৃষক থাইকতে পারলাম না। সামনের বছর থেকে অন্যের জমিতে মজুরি দিব। তাতে পেটে কয়টা দানা–পানি হলেও পড়বে।’