পুনঃ তফসিলের ৩০ শতাংশ ঋণই এখন খেলাপি

>

দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হলেও পুরো ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে।

দেশে শিল্প খাতের ঋণই সবচেয়ে বেশি খেলাপি হচ্ছে। পুনঃ তফসিলও বেশি হচ্ছে শিল্পঋণ। আর ব্যাংকগুলো এ ধরনের ঋণ যে পুনঃ তফসিল করছে, তার ৩০ শতাংশ আবার পরের বছরেই খেলাপি হয়ে পড়ছে। যে কারণে ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি হওয়া ঠেকাতে ব্যাংকগুলোর পুনঃ তফসিলীকরণের কৌশল তেমন কাজে আসছে না।

ব্যাংকগুলোর পুনঃ তফসিল হওয়া ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে, যা ২০১৮ সাল শেষে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকায়। অথচ চার বছর আগে ২০১৪ সালে পুনঃ তফসিল ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি প্রতিবেদন ২০১৮ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গতকাল মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে একটি ঘরোয়া আলোচনা সভার আয়োজন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। তবে খারাপ হয়েছে পুরো ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগের চেয়ে বেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্যাংকের ঋণের চেয়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি আরও কমেছে। আর তারল্যসংকট মেটাতে ব্যাংকগুলো অন্য ব্যাংক, বিশেষত সরকারি ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর মধ্যে পরস্পরের কাছ থেকে ধার নেওয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭০ হাজার ৬১০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক আমানতের কম সুদ ও সঞ্চয়পত্রের বেশি সুদের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অন্য ব্যাংকের আমানতই ২০১৮ সালের তারল্য ব্যবস্থাপনায় বড় সহায়তা করেছে। আর ব্যাংকের সম্পদের মানও আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে।

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে গভর্নর ফজলে কবির বলেছেন যে ব্যাংকিং খাতে পুঞ্জীভূত মন্দঋণ কমাতে ব্যাংকারদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এ সময় তিনি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে ঋণ ও আমানতের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার আহ্বান জানান।

কৃষিঋণই সবচেয়ে ভালো

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর খেলাপি হওয়া ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের যে প্রবণতা দেখা গেছে তাতে কৃষি খাতের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। ২০১৮ সালে যে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করা হয়, তার সাড়ে ৬ শতাংশ বাণিজ্যিক খাতে নেওয়া। এসব ঋণের মধ্যে ৪২ শতাংশই আবার খেলাপি হয়ে গেছে। এ ছাড়া নির্মাণ খাতের ২৫ শতাংশ, বৈদেশিক বাণিজ্যের ৩৫ শতাংশ ও শিল্পঋণের ৩০ শতাংশ পুনরায় খেলাপি হয়েছে। আর পুনঃ তফসিল হওয়া ঋণের মধ্যে বড় ঋণ ৫৮ শতাংশ, মধ্যম মানের ঋণ ১৫ শতাংশ, ছোট ঋণ ৭ শতাংশ, ক্ষুদ্র ও কটেজ ঋণ ২ শতাংশ ও অন্যান্য প্রায় ১৮ শতাংশ।

ব্যাংক খাতের নিট মুনাফা কমেছে

২০১৮ সালে ব্যাংক খাতে তীব্র তারল্যসংকট ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ কিছু ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে অন্য ব্যাংকগুলো দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়েছে। ফলে ব্যাংক খাতের নিট মুনাফা কমেছে। ২০১৭ সালে যেখানে ব্যাংক খাতের নিট মুনাফা ছিল ৯ হাজার ৫১০ কোটি টাকা, সেখানে গত বছরে তা কমে হয়েছে ৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে নিট মুনাফা ছিল ৭ হাজার ৯২০ কোটি টাকা ও ২০১৬ সালে ৮ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যাংক খাতের অন্যান্য আয় বাড়লেও বিনিয়োগ থেকে আয় কমেছে।

খারাপ হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো

২০১৮ সালে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। বেড়েছে ধার ও খেলাপি ঋণ। কমেছে মুনাফা। ২০১৮ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে যা ছিল ৪ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল ৪ হাজার কোটি ও ২০১৬ সালে ছিল ৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। আর এসব প্রতিষ্ঠানের নিট মুনাফা ২০১৮ সালে কমে হয়েছে ৮৯০ কোটি টাকা, যা ২০১৭ সালে ছিল ৯৫০ কোটি টাকা।