ব্যাংক থেকে এত টাকা গেল কোথায়

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

একদিকে বিশাল অঙ্কের বাজেট, অন্যদিকে টাকাশূন্য ভল্ট। একদিকে ব্যয়ের ব্যাপক আয়োজন, অন্যদিকে টাকার জন্য হাহাকার। এ রকম এক বিপরীত অবস্থার মধ্য দিয়েই নতুন অর্থবছরের জন্য নতুন বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ প্রাণ নেই ব্যাংক খাতে। বিনিয়োগের জন্য নেওয়া শিল্পঋণ যেখানে পুরোটাই ব্যাংক খাতনির্ভর, সেখানেই চলছে তীব্র অর্থসংকট। সবার মনেই প্রশ্ন, তাহলে ব্যাংকের এত টাকা গেল কোথায়? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণের টাকা ফেরত আসছে না ব্যাংক খাতে, খেলাপি ঋণ কেবল বাড়ছেই। পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের টাকা। এতে আস্থার অভাবে নতুন আমানত আসছে না এখানে। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত এখন মহাবিপদে।

বাংলাদেশ অটোরি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস সমিতির চেয়ারম্যান মানোয়ার হোসেনেরও একই প্রশ্ন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার অবাক লাগে, আসলে টাকা যাচ্ছে কোথায়। সরকারের এটা খুঁজে দেখা উচিত। কালোটাকা ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে চলে যাচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা উচিত।’

দেশের অর্থনীতি এখন বেসরকারি খাতনির্ভর। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও মূল ভরসা তারা। অথচ ব্যাংক খাতে নগদ অর্থ না থাকায় বিপাকে পড়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। নতুন ঋণ পেতে যেমন সমস্যা হচ্ছে, আবার তা পেলেও সুদহার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর পুরোনো উদ্যোক্তারাও ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে পারছেন না চাহিদামতো টাকা ও ডলারের অভাবে।

ব্যাংক থেকে ব্যবসায়ীরা চাইলে ঋণ পাচ্ছেন কি না, জানতে চাইলে মানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘না। বড় বা মাঝারি, কেউই টাকা পাচ্ছে না। আমরা চলতি মূলধনও পাচ্ছি না। এটা সত্যিই একটা গুরুতর পরিস্থিতি।’ অর্থনীতি সচল থাকলে, উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটলে তবেই রাজস্ব খাতে আদায় বাড়ে। কিন্তু ব্যাংক খাত সংকটে পড়ায় এর প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে। এই ব্যাংক খাত চাঙা করাই হবে নতুন অর্থমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান এ নিয়ে বলেন, ব্যাংকে ঋণ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ না থাকলে সেটার প্রভাব পুরো অর্থনীতিতে পড়ে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি গত ডিসেম্বর থেকে কমছে। সুদের হার বাড়ছে। এসব দিক বিবেচনায় অর্থনীতি একটু কঠিন অবস্থায় আছে বলা যায়। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকনির্ভরতা কমাতে আগামী বাজেটেই বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

সুদহারে বিশৃঙ্খলা
টাকার সংকটে এখন আমানতের পেছনে ছুটছেন বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ থেকে শাখা পর্যায়ের ব্যাংকাররা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারি ব্যাংক থেকে টাকা ধার করেই দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো।

ব্যাংকগুলোর মে মাসভিত্তিক তারল্য পরিস্থিতির খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক ছাড়া হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাংকের হাতে বিনিয়োগ করার মতো টাকা আছে। এমন পরিস্থিতিতে তারল্য সংগ্রহে রীতিমতো আগ্রাসী আচরণ করছে কোনো কোনো ব্যাংক। যেমন সাড়ে পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণ করার আশ্বাসে আমানত সংগ্রহ করছে বেসরকারি খাতের পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক)। যাতে সুদহার পড়ছে ১৪ শতাংশের বেশি। অথচ টাকা দ্বিগুণ করতে নয় বছর সময় নিচ্ছে বেসরকারি খাতের দি সিটি ব্যাংক, যাতে সুদহার পড়ছে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ফলে একই বাজারে কেউ ৭ শতাংশ, আবার কেউ ১৪ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার প্রতিনিয়ত বাড়ছেই, যা ১৬-১৭ শতাংশ পর্যন্ত ঠেকেছে।

ব্যাংক খাতের সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তারল্যের ২৬-২৭ শতাংশ সঞ্চয়পত্রে চলে গেছে। বেশি সুদ ও কর ছাড়ের কারণে সবাই সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন। আবার আমদানি যে হারে বাড়ছে, সে হারে রপ্তানি বাড়েনি। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্যের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। আবার খেলাপি ঋণের কারণে অনেক টাকা আটকা পড়েছে। বর্তমান যে তারল্যসংকট চলছে, তা দূর করতে খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে। পাচার করা টাকা ফিরিয়ে এনে বিনিয়োগে করতে হবে।

>

একই বাজারে কেউ ৭ %, কেউ ১৪% সুদে আমানত নিচ্ছে।
এতে ঋণের সুদহার ১৬-১৭% পর্যন্ত ঠেকেছে।
প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে, অথচ প্রাণ নেই ব্যাংক খাতে

উল্লেখ্য, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি বলছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৫ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা।


ঋণ পাচ্ছে কারা
ব্যাংকগুলোর খাতভিত্তিক ঋণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত তিন বছরে নির্মাণশিল্প ও ঠিকাদারদের কাছেই সবচেয়ে বেশি ঋণ গেছে। সরকারের মেগা প্রকল্পে যেসব ঠিকাদার কাজ করছেন, তাঁরাই মূলত ঋণ পাচ্ছেন। ব্যাংকগুলোও এসব ঋণে আগ্রহী, কারণ সহজেই সরকারি বিলের টাকায় এসব ঋণ শোধ হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে নির্মাণশিল্প ও ঠিকাদারদের কাছে ঋণ ছিল ৪৮ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে যা বেড়ে হয় ৫৪ হাজার ২২০ কোটি টাকা। ২০১৮ সাল এসব খাতে ঋণ বেড়ে হয়েছে ৬১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহাসড়কের চার লেনসহ বেশ কয়েকটি বড় নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে। আবার জেলা পর্যায়েও বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলছে। এসব অনেক প্রকল্পের সরাসরি ঠিকাদার বিদেশি হলেও স্থানীয় ঠিকাদারেরা বেশির ভাগ কাজ করছেন। আবার স্থানীয়রা সরাসরি অনেক কাজ করছেন। তাঁরাই এখন ব্যাংকের মূল গ্রাহক।

ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সব ব্যাংকই ঠিকাদারদের ঋণ দিতে আগ্রহী। কারণ, সরকারি প্রচুর কাজ হচ্ছে। সরকারি বিল হলেই ঋণ শোধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক ঠিকাদারই এর সঙ্গে যুক্ত।

আবারও করের টাকা ব্যাংকে
বেসরকারি ব্যাংকে টাকা নেই, আর সরকারি ব্যাংকের নেই পর্যাপ্ত মূলধন। ফলে সরকারি ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে প্রায় করের বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি ২২ হাজার কোটি টাকা। আর এসব ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে প্রতিবছরই দেওয়া হচ্ছে জনগণের করে টাকা। গত ছয় বছরে এভাবে দেওয়া হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ও বেসিক ব্যাংকই পেয়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। যদিও তার আগের ১০ বছরে এ ব্যাংকগুলোকে দিতে হয়েছিল মাত্র ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরের মতো আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ও ব্যাংকগুলোর জন্য ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

দর্শকের ভূমিকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ব্যাংক খাতের তীব্র এই সংকটের সময়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। উপরন্তু ঋণ খেলাপিদের সুবিধা দিতে দফায় দফায় নীতিমালা পরিবর্তন করা হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে ১১টি শিল্প গ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুটি গ্রুপ ছাড়া আর কেউ টাকা পরিশোধ করেনি।

সামগ্রিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ব্যবস্থাও। ফলে নানা ধরনের অনিয়ম করেও শাস্তি পাওয়ার উদাহরণও কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংক খাতে অনেক সমস্যা চলছে। এ জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে হলেও একটা ব্যাংক কমিশন করা যেতে পারে। এভাবে ব্যাংক খাতের সমস্যার সমাধান হতে পারে।