আস্থা ও ভালো শেয়ারের সংকটই বড় চ্যালেঞ্জ

বিনিয়োগকারীদের আস্থার ভিত শক্তিশালী করে দীর্ঘ মেয়াদে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাটাই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন বাজেটে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী কী পদক্ষেপ থাকছে, তার অপেক্ষায় বিনিয়োগকারীরা।

বাজেট সামনে রেখে এরই মধ্যে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নানা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। এ প্রত্যাশা তৈরি করেছেন অর্থমন্ত্রী নিজেই। শেয়ারবাজারের টানা পতনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, যেহেতু পুঁজিবাজার ও অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সংগত কারণেই পুঁজিবাজারের জন্য আগামী বাজেটে প্রণোদনা থাকবে। এখন অর্থমন্ত্রীর সেই প্রণোদনায় আশায় আছেন বিনিয়োগকারীরা।

দেশের শেয়ারবাজারের বড় সংকট বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যুতে নড়বড়ে হয়ে ওঠে বিনিয়োগকারীদের আস্থা। তার ওপর বাজারে ভালো শেয়ারের বড় ধরনের সংকট রয়েছে। এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একাধিকবার সরকারি ২৬টি কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত একটিকেও বাজারে আনতে পারেননি। এমনকি গত ১০ বছরে বেসরকারি ও বহুজাতিক মানসম্মত কোনো কোম্পানিও বাজারে আসেনি।

ভালো কোম্পানি বাজারে না আসায় মন্দ মানের কোম্পানি নিয়ে বাজারে কারসাজির ঘটনা ঘটছে অহরহ। এসব কারসাজির ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০০৯ সালে গ্রামীণফোন তালিকাভুক্ত হওয়ার পর এ কোম্পানিটির সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে বেশ কিছু বিনিয়োগকারীও বাজারে আসে। এরপর ২০১০ সালে বাজারে ধস নামে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হন কয়েক লাখ বিনিয়োগকারী। ওই ধসের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একাধিক মামলা হয়। প্রকাশ করা হয় শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নাম। কিন্তু কারোরই কোনো শাস্তি হয়নি আজ পর্যন্ত। এ কারণে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপরও বিনিয়োগকারীদের আস্থার ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া মানহীন কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেওয়া নিয়েও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে।

এমন পরিস্থিতিতে বাজেটে অর্থমন্ত্রী শেয়ারবাজারের সংস্কারে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, তার ওপর নির্ভর করছে বাজারের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা। বাজেটকে সামনে রেখে কয়েক দিন ধরে শেয়ারবাজারের সূচক ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও লেনদেনের খরা এখনো কাটেনি।

বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক মোহাম্মদ মুসা বলেন, শেয়ারবাজারকে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতা দিতে হলে সবার আগে দরকার বিনিয়োগকারীদের আস্থার ভিত শক্তিশালী করা। বাজারের ওপর আস্থা না থাকলে প্রণোদনা দিয়ে বাজারকে খুব বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া যাবে না। বর্তমানে ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট প্রকট। এ সংকট কাটানোর উদ্যোগ নেওয়া না হলে শেয়ারবাজারের তারল্য-পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে না।

২০১৫ সালের নভেম্বরে ভারতের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়ার (সেবি) তৎকালীন চেয়ারম্যান ইউ কে সিনহা বাংলাদেশ এসে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, যে শেয়ারবাজারে সুশাসনের ঘাটতি থাকে সেই বাজারে দেশি-বিদেশি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখান না। আর বাজারে আইনের শাসন থাকলে কিছুসংখ্যক বিনিয়োগকারী ভয়ে থাকেন, কিন্তু তা বাজারের ওপর বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীর আস্থা বাড়াতে সহায়তা করে।

শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য সেবির সাবেক চেয়ারম্যান যেসব কথা বলেছিলেন, তার সবই অনুপস্থিত বাংলাদেশের বাজারে। আইনের কঠোর প্রয়োগের ঘাটতি যেমন এ বাজারে প্রকট, তেমনি প্রকট আস্থার সংকট।

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল ও বিনিয়োগ আকর্ষণের কেন্দ্রে নিতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কারসাজি করে নামমাত্র জরিমানায় কেউ যেন পার পেয়ে না যান, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে বিনিয়োগে আনতে হলে মিউচুয়াল ফান্ড খাতে বড় ধরনের সংস্কার জরুরি। বর্তমানে মিউচুয়াল ফান্ডের ওপর বিনিয়োগকারীদের একেবারে আস্থা নেই বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

>

শেয়ারবাজারের বড় সংকট বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা
বিভিন্ন ইস্যুতে নড়বড়ে হয়ে ওঠে বিনিয়োগকারীদের আস্থা
তা ছাড়া বাজারে ভালো শেয়ারের বড় ধরনের সংকট আছে
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা থাকবে
অর্থমন্ত্রীর সেই প্রণোদনায় আশায় আছেন বিনিয়োগকারীরা

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সাবেক সভাপতি, ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) বর্তমান সভাপতি শাকিল রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, সুশাসন, ভালো শেয়ারের অভাব, মিউচুয়াল ফান্ড খাতের চরম দুরবস্থা ও অব্যবস্থাপনাসহ নানাবিধ কারণে শেয়ারবাজার নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। এতে করে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ যেমন এ বাজারে আসছে না, তেমনি ভালো উদ্যোক্তারা সুনাম হারানোর ভয়ে বাজারে আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

শাকিল রিজভী আরও বলেন, ‘বিশ্বের বড় বড় অনেক কোম্পানি ও ভালো উদ্যোক্তারা তাঁদের কোম্পানিকে নিউইয়র্ক, হংকংয়ের মতো বাজারে তালিকাভুক্ত করতে পারলে গর্বিত বোধ করেন। আর আমাদের বাজারের ক্ষেত্রে ঘটছে ঠিক উল্টোটা। সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে অনেক ভালো কোম্পানি ও উদ্যোক্তা বাজারে আসতে ভয় পান। দেশের সঞ্চয়কারী ও ভালো উদ্যোক্তাদের মধ্য থেকে শেয়ারবাজার নিয়ে যে খারাপ ধারণা রয়েছে, সেটি দূর করায় সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।’

বাজেটে থাকছে প্রণোদনা
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের করমুক্ত লভ্যাংশ আয়ের সীমা ২৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেছে ডিএসই। এ ছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে বড় দাবি ছিল তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও তালিকাভুক্ত নয়—এমন কোম্পানির মধ্যে করপোরেট কর হারের ১৫ শতাংশ ব্যবধান তৈরি করা। এর বাইরে লেনদেনের ওপর ধার্য অগ্রিম করহার কমানো, এসএমই বোর্ডে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য কয়েক বছরের কর অবকাশ সুবিধা, বন্ড বাজারের উন্নয়নে কর প্রতিবন্ধকতা দূর করার পাশাপাশি কর সুবিধা প্রদান এবং পাঁচ বছরের জন্য স্টক এক্সচেঞ্জকে কর অবকাশ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন বাজেটে পুঁজিবাজারবান্ধব বেশ কিছু প্রণোদনা থাকবে। আমরাও আশা করছি বাজারের উন্নয়নে বাজেটে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিএসইসির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তাবও অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে।’

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য একগুচ্ছ প্রণোদনা থাকছে। একদিকে যেমন বিনিয়োগকারীদের কর ছাড় দেওয়া হবে, অন্যদিকে কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও কর ছাড় দেওয়া হতে পারে। বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশের ওপর করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বর্তমানে বার্ষিক ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশে কোনো কর দিতে হয় না। এটি বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

অন্যদিকে কোম্পানির ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নভাবে করপোরেট করে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে কোম্পানিগুলো শেয়ারধারীদের দুই ধরনের লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। এগুলো হলো বোনাস লভ্যাংশ ও নগদ লভ্যাংশ। সরকার কোম্পানিগুলোকে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণায় উৎসাহিত করতে চায়। এ জন্য যেসব কোম্পানি নগদ লভ্যাংশ দেবে, সেসব কোম্পানিকে কিছুটা কর ছাড় দেওয়া হতে পারে। এখন শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়।

এদিকে খরায় থাকা বন্ড মার্কেটকে চাঙা করতেও বাজেটে প্রণোদনা থাকছে। বন্ড তালিকাভুক্ত করার ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের খরচ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বন্ড ছাড়লে নিবন্ধন ফিসহ যাবতীয় খরচ কমানো হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নামমাত্র খরচে বন্ড তালিকাভুক্ত করা যাবে।

বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত একটি করপোরেট বন্ড আছে। এটি ইসলামী ব্যাংকের আইবিবিএল মুদারাবা বন্ড। এটিই শুধু লেনদেন হয়। এ ছাড়া ২২১টি ট্রেজারি বন্ড আছে। এই বন্ডগুলো লেনদেন হয় না।