উপাত্তনির্ভর আকাঙ্ক্ষা আছে, সুস্পষ্ট কর্মকৌশল নেই

হোসেন জিল্লুর রহমান
হোসেন জিল্লুর রহমান

অর্থবছরের মাঝপথে দায়িত্ব নিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। সেই হিসেবে খুব বেশি সৃজনশীল হওয়ার কতটা সুযোগ ছিল সেটা একটা প্রশ্ন। এ জন্য আমলাতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাই যে মূল সুর হবে, সেই প্রত্যাশাই হয়তো ছিল। বাস্তবতায় আমলাতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার বিষয় আছে। কিন্তু চিন্তাটাও কী আমলাতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার বহিঃপ্রকাশ হতে হবে? বাজেটে আকাঙ্ক্ষার কথাগুলো উপাত্ত দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ ধরা হয়েছে। আকাঙ্ক্ষাকে এক ধরনের বাস্তবতা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন কর্মকৌশলের আকাঙ্ক্ষা হওয়া উচিত। তবে বাজেটে উপাত্তের আকাঙ্ক্ষার মধ্যেই থাকা হয়েছে। বাস্তবতার সুষ্ঠু বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্য কর্মকৌশলের কোনো ছাপ বা আকাঙ্ক্ষা দেখতে পাইনি।

যে দুইটি অর্থনৈতিক চালকের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের অর্থনীতি চলছে ওই দুইটিই এখন চলছে। এর একটি হলো তৈরি পোশাক খাত অন্যটি প্রবাসী আয়। প্রবৃদ্ধির নতুন কোনো চালকের বিষয়ে এখানে কোনো কথা আসেনি। আকাঙ্ক্ষার সুস্পষ্টীকরণের যে অভাব সেটা বাজেটে রয়ে গেছে। যেমন এক অঙ্কে ব্যাংক সুদ করা হবে বলা হয়েছে। এটা তো আগেও বলা হয়েছে। কিন্তু এটা কীভাবে করা হবে বা বিশ্বাসযোগ্যভাবে কীভাবে হবে সেটা সুস্পষ্ট করা হয়নি। বাজেটে কৌশলগত চিন্তার সুস্পষ্টীকরণের ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি।

আমাদের বাজেটে আমলাতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা থাকেই। তবে এর মধ্যে নতুনত্বের কিছু দিক থাকে। কিন্তু তেমনটি এবারের বাজেটে নেই।

এবার বাজেট পেশের বিষয়টি একটি লক্ষনীয় দিক ছিল। তা হলো, অর্থনীতি পরিচালনা টিমের প্রায় সবাই ব্যবসায়ী। এই টিম বলতে আমরা যা বুঝি অর্থমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের। এবারে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, অর্থনৈতিক পরিচালনার টিমে ব্যবসায়ী মহলের প্রতিনিধিত্ব যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ। অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ী, বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী, ব্যক্তি খাতের উপদেষ্টা তিনি আবার সাংসদও হয়েছে তিনি ব্যবসায়ী, বিদ্যুৎমন্ত্রী ব্যবসায়ী, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী ব্যবসায়ী, খাদ্যমন্ত্রী ব্যবসায়ী। এবারের এক অর্থে ব্যবসায়ী মহল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। আগের অর্থমন্ত্রীরা ঘুরে-ফিরে সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। এটি নতুন একটি বাস্তবতা। অর্থ ব্যবস্থাপনা কারা করছে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও পদবি দিয়ে বোঝা মুশকিল যে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে কারা আছেন। তবে তাঁরা যারা সামনে আছেন তারা সবাই ব্যবসায়ী। ওনাদের তো নতুন ধরনের কৌশল থাকতে পারত আমলাতান্ত্রিক গতানুগতিকতার বাইরে। সেটা কিন্তু একেবারেই দেখা যায়নি। সেই অর্থে তাঁরা ব্যক্তি খাতের না গোষ্ঠীখাতের প্রতিনিধিত্ব করলেন তা বুঝতে পারছি না। এটা এখানে বলে রাখি যে, আমাদের এই বাজেট প্রতিক্রিয়াগুলো চার পাঁচ দিন পরে আরও গভীরভাবে দেওয়া সম্ভব হবে।

বাজেটের উদ্দেশ্য তো অর্থনীতিকে আরও বেগবান করা। শুধু বেগবান করা নয়, অর্থনীতির প্রয়োজন কী সেটাও তুলে ধরা। অর্থনীতি এখনো খুব মারাত্মক অবস্থায় না গেলেও আর্থিক ঝুঁকির বিষয়টি রয়ে গেছে। বৈদেশিক সাহায্য থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছি। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা আবার বেড়ে যাচ্ছে। উচ্চ সুদের বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে।

আমাদের রাজস্ব আয়ের ঘাটতিগুলো প্রকট হচ্ছে। এত পরিমাণ প্রবৃদ্ধি যদি হয় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি কেন হচ্ছে? ব্যাংকিং সেক্টরের এই অবস্থা কেন হচ্ছে? বেসরকারি বিনিয়োগ কেন স্থবির। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার।

আমি অর্থনীতির পাঁচটি চ্যালেঞ্জ দেখি। প্রথম হচ্ছে বৈষম্য। সরকারি পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে বৈষম্য বাড়ছে। এটা শুধু ধনী-দরিদ্র নয় আঞ্চলিক বৈষম্যও বাড়ছে। দ্বিতীয়, আমাদের প্রবৃদ্ধি যে মাত্রায় দরিদ্রবান্ধব ছিল এখন সেই মাত্রায় দরিদ্রবান্ধব নয়। এক শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে আগে যে হারে দারিদ্র্য কমতো এখন তার চেয়ে কম দারিদ্র্য কমছে। এটাও কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যানে দেখছি। তৃতীয়ত হচ্ছে বেকারত্ব। বিশেষ করে তরুণ বেকার। চতুর্থটা আগেই বলেছি, আর্থিক ঝুঁকির বিষয় আরও বেশি হচ্ছে। এখনো চরম অবস্থায় যায়নি তবে ঝুঁকিটা আছে। পঞ্চম চ্যালেঞ্জটি হলো, এটা খুব জরুরি। ঘুরে ফিরে ৩০ বছর ধরে আমরা প্রবৃদ্ধির দুই চালকের ঘাড়ে চড়ে এগোনোর চেষ্টা করছি। নতুন কিছুর সন্ধান করতে হবে।

এখন আমাদের এসব চ্যালেঞ্জের নিরিখেই বিশ্লেষণ দরকার, বাজেটটা এসব চ্যালেঞ্জ কতটুকু বুঝতে পেরেছে। এগুলো আসল চ্যালেঞ্জ কি না, সেই উপলব্ধি তাদের আছে কি না। নতুন বরাদ্দ না দিতে পারলেও নতুন কর্মকৌশলের কথাও আমরা বলতে পারছি কি না, তার বোঝা দরকার। আমরা কিছু কর্মসূচির কথা শুনলাম যেমন শস্যবীমা, নদী ভাঙনের ফলে সহায়তা তরুণদের ব্যবসার উদ্যোগে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ ইত্যাদি। এসব নিয়ে কর্মসূচি শুনলাম কিন্তু কোনো কর্মকৌশল পেলাম না।

কর্মকৌশলের ক্ষেত্র যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হলো মানব সম্পদ উন্নয়ন। আমরা আশা করেছিলাম এ বিষয়ে কিছু থাকবে, তারা বুঝতে পারবে আগামী দিনগুলোতে এটা কতটা জরুরি। তবে সেখানে জোরালো কিছু নেই। শিক্ষা খাতে কী হলো? অর্থ যা ছিল সেটাই এখন এমপিও খাত যোগ করা হয়েছে। এখানে বড় বরাদ্দ হয়েছে। এমপিওর জগৎ আবার সম্প্রসারিত হয়েছে। এমপিওর মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষা কিন্তু নিশ্চিত করা যাবে না। যদি মানসম্মত শিক্ষার দিকে যেতে হয় তবে ভবিষ্যতে এই এমপিওর পুরো বিষয়টিই পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

এবার বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার খাতের আকার বেড়েছে। তবে তা আনুপাতিক হারে বরং তা কমেছে। সামাজিক নিরাপত্তার অনেক প্রকল্প আছে। তবে খাত মূলত চারটিই। একটি হচ্ছে, মৌসুমি বেকারত্ব দূরের জন্য কর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প। এর মধ্যে আছে কাবিখা, ইজিপিডি ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য কিছু প্রকল্প। নদী ভাঙন বা শস্য বিমার প্রকল্প এর মধ্যে আছে। তৃতীয় ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয় আমাদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা অক্ষমতার শিকার তাদের জন্য প্রকল্প। এর মধ্যে আছেন বিধবা, বয়স্ক বা প্রতিবন্ধী মানুষ। চতুর্থ একটা বিষয় আছে। মানবসম্পদ বৃদ্ধির জন্য সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচিতে কিছু কাজ করা হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বৃত্তি। এসব মানবসম্পদ বৃদ্ধির জন্য। মানবসম্পদ বৃদ্ধির জন্য যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সেখানে বড় ধরনের চমক সৃষ্টির সুযোগ ছিল। আমি আশা করি এ বছর না হলেও আগামী বছর এটি নিয়ে তারা চিন্তাভাবনা করবে। এখানে তিনটি সুযোগ রয়ে গেছে। যেমন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বৃত্তির পরিমাণটা এটা একেবারে দ্বিগুণ করে দেওয়া সম্ভব ছিল। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য খাতে সামাজিক নিরাপত্তার কথা তারা ভাবতে পারতেন। স্বাস্থ্য খাতে কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেই। পাইলট প্রকল্প আছে, তা খুড়ে খুড়ে চলছে। ভবিষ্যতে নগর দরিদ্রদের কথা মাথায় রেখে স্বাস্থ্যখাতে নিরাপত্তা কর্মসূচি নেওয়া যেত। তৃতীয় বিষয়টি নিয়ে সরকারের মধ্যে চিন্তাভাবনা আছে। বাজেটে কতটা তা এখনো দেখিনি। সেটা হলো স্কুলে মিল চালু করা। সামাজিক নিরাপত্তা একটি কৌশলগত বিষয়।

অর্থমন্ত্রী বাজেটের শুরুতেই বলেছেন, ‘এখন আমাদের সময়।’ এই আমাদের বলতে কাদের বোঝাচ্ছি? সারা জাতিকেই ‘আমাদের’ শব্দটির মধ্যে আনতে পারছি কি না সেটা বড় প্রশ্ন। বৈষম্য যদি আমরা বিবেচনায় না নিই তবে ‘আমাদের’ শব্দটিকে কোটেশনের মধ্যে রাখতে হবে। এটা তাহলে দুঃখজনক বিষয় হয়ে যাবে। এখন আমাদের সময় তো বটেই। কিন্তু সবাইকে এর মধ্যে আনা যাচ্ছে কি? এখন কৃষকের একটা সমস্যা চলছে, সেখানে শস্যবীমা করেই সমাধান হবে? শস্যবীমা শুনতে ভালো কিন্তু এটা কতটুকু টেকসই হবে?

বাজেট বলি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাই বলি, ব্যয়ের দক্ষতা একটা বড় সমস্যা। এই জায়গায় কিছু নীতি মেনে চলতে হবে। একদিকে সীমিত সম্পদ আবার অন্যদিকে অপচয়ের প্রবণতাও আছে। আমরা প্রকল্প ব্যয় ধরি অত্যধিক। বিদ্যুৎ কিনছি বেশি দাম দিয়ে। ব্যয়ের দক্ষতাটা খুব জরুরি।

আমাদের সংকীর্ণ উপাত্তভিত্তিক উন্নয়ন নিয়ে একমাত্রিক যে আলোচনা সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরতে হবে। প্রবৃদ্ধির নতুন চালকের সন্ধান করতে হবে। অর্থনীতির ভিত্তিটা বদলাতে হবে।

*হোসেন জিল্লুর রহমান, নির্বাহী চেয়ারম্যান, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি)