বড় সংস্কারের প্রস্তাব নেই

আবুল কাসেম খান
আবুল কাসেম খান

বাজেটে চমক নেই। আমরা ভেবেছিলাম, নতুন অর্থমন্ত্রী এসেছেন, তিনি হয়তো নতুন কিছু করবেন বা বড় সংস্কারের প্রস্তাব দেবেন, কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। সরকার ১০ বছর ধরে বাজেট দিয়ে আসছে, সেই ধারাবাহিকতাই রক্ষা করল।

আমাদের কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানো। কয়েক বছর ধরেই এটি একরকম স্থবির হয়ে আছে। অর্থনীতি বড় হচ্ছে বলে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রতিবছরই বাড়ছে। কিন্তু সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আমরা যে জিডিপির ২৮ শতাংশ বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলাম, তা অর্জন করতে পারিনি।

এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারার পেছনের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে—অবকাঠামোগত সমস্যা, সহজে ব্যবসার সূচকে পিছিয়ে থাকা, ব্যাংকিং খাতের বিপুল খেলাপি ঋণ ইত্যাদি। সরকারের বড় বড় প্রকল্পের কারণে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। কিন্তু কথা হলো, এসব প্রকল্প তো চিরকাল থাকবে না। বেসরকারি খাতই যেহেতু অর্থনীতির প্রাণ, সেহেতু এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।

বাজেটের যে আকার তা বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য ঠিকই আছে। কিন্তু রাজস্ব আদায়ে যেখানে গত বছর ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সেখানে এবার তা ১৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকার ভ্যাট থেকেই বাড়তি টাকাটা তুলবে। সে জন্য নতুন ভ্যাট আইনের জন্য ব্যবসায়ীদের দাবি সরকার মেনে নিয়েছে। আশার কথা হলো, আয়কর আদায়ে গত অর্থবছরে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সে জন্য ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো করের হার কমিয়ে করজাল বাড়ানোর কথা বলে।

অন্যদিকে কর্মসংস্থান বাড়ানো দেশের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ। সরকারি চাকরিতে বেশি মানুষের সংস্থান হয় না। বেসরকারি খাতই কর্মসংস্থানের মূল জায়গা। তাই এই খাতকে আরও উৎসাহ-উদ্দীপনা দেওয়া দরকার।

বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধিকে স্বাগত জানাই। বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী জাপানের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, তারা কীভাবে বিদেশ থেকে শিক্ষক-প্রশিক্ষক এনে জনগণকে শিক্ষিত করেছে। আমাদেরও সে পথে যেতে হবে। আমরা তো এখন বিদেশি পরামর্শক, বিশেষজ্ঞ বা কর্মী নিয়ে আসছি। তাঁরা বিপুল বেতন পাচ্ছেন এবং একসময় আবার চলেও যাচ্ছেন। কিন্তু শিক্ষক-প্রশিক্ষক নিয়ে এলে তাঁরা জ্ঞান বা দক্ষতা ছড়িয়ে দিতে পারবেন।

অন্যদিকে স্টার্টআপ তহবিলে ১০০ কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্তকেও স্বাগত জানাই। সবাই তো আর চাকরি করতে আসবে না। উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রণোদনা দিতে হবে। দরকার হলে এই তরুণদের জোর করে টাকা দিয়ে বলতে হবে, ব্যবসা করো, কিন্তু বিদেশে চলে যেতে পারবে না।

বিপুল কর্মসংস্থানের জন্য বড় বড় কারখানা দরকার। বড় বড় প্রতিষ্ঠান দেশে আসতেও চায়। সে জন্য আমরা ভেবেছিলাম, সরকার করপোরেট কর কিছুটা কমাবে। অন্যদিকে সহজে ব্যবসার সূচকের কথাও বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে আসছে। সরকারের সংস্কার কর্মসূচিতে এটি রাখতে হবে। আশার কথা হলো, সরকার কিছু জায়গায় হাত দিয়েছে। সরকার করজাল বাড়ানোর কথা বলেছে বাজেটে। এক কোটি মানুষকে করের আওতায় আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। মানুষের সামর্থ্য বেড়েছে। তাই এটি করা খুবই সম্ভব। এ জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

ঢাকা চেম্বারসহ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো কর কার্ডের প্রস্তাব দিয়েছিল। সরকার ২০১০ সালে তা গ্রহণও করে। কিন্তু শুধু সিআইপি বা বড় করদাতাদেরই নয়, সব শ্রেণির করদাতাদেরই এই কার্ড দিতে হবে। করদাতাদের সব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে মানুষ উৎসাহিত হবে। এ ছাড়া কর দিলে দীর্ঘ মেয়াদে স্কুল, কলেজ ও হাসপাতালের মান ভালো হবে—মানুষকে সেই স্বপ্ন দেখাতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

সরকার বিকল্প অর্থায়নের কথা বলেছে। দেরি হয়ে গেলেও এটি ভালো উদ্যোগ। ব্যাংক-নির্ভরতা কাটিয়ে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের জন্য পুঁজিবাজারমুখী হওয়ার যে কৌশল সরকার প্রণয়ন করছে, তা আশাব্যঞ্জক। শুধু দীর্ঘমেয়াদিই নয়, পুঁজিবাজার থেকে স্বল্পমেয়াদি অর্থায়ন সংগ্রহেরও ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা এ ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেখতে চাই। পুঁজিবাজারে আসতে হলে পরপর তিন বছর মুনাফা করার যে শর্ত আছে, তা উঠিয়ে দেওয়া উচিত।

অর্থায়নের জন্য অতিমাত্রায় ব্যাংক নির্ভরতার কারণে ব্যাংকের ওপর চাপ বাড়ছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ভালো ঋণগ্রহীতাদের উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। এতে তাদের মুনাফা এবং দেশের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এটি তাদের সঙ্গে অন্যায় করার শামিল। অন্যদিকে করমুক্ত লভ্যাংশ আয়ের সীমা দ্বিগুণ করা হয়েছে—অত্যন্ত সাধু উদ্যোগ, বিনিয়োগের জন্য অনুকূল।

অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন বাড়ানোর কথা বলেছেন। ব্যাংকিং আইনের সংস্কারের কথাও বলেছেন—এটিও ভালো উদ্যোগ, যদিও এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলেননি তিনি। তবে আশা করি, এ থেকে ভালো কিছু আসবে। রুগ্ণ ব্যাংকগুলোকে একত্রীকরণের কথা বলেছেন তিনি। এটিও ভালো উদ্যোগ। ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। ভালো কথা, কিন্তু আমরা এর বাস্তবায়ন দেখতে চাই। এ ব্যাপারে বাস্তব কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা দেখতে চাই। তবে এক অঙ্কের সুদের কথা যে তিনি বলেছেন, তা বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ, এটি বাজারের চাহিদা-সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল।

অন্যদিকে কোম্পানি আইনে হোল্ডিং ও সাবসিডিয়ারি কোম্পানির বিধান সংস্কারের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। আমরা মনে করি, এটি করার এখনই সুবর্ণ সময়। এ ক্ষেত্রে হোল্ডিং ও সাবসিডিয়ারি কোম্পানির দ্বৈত করের প্রসঙ্গ আসবে। এসবই ভালো উদ্যোগ। তবে আমরা কর হারে কিছু ছাড় চেয়েছিলাম, তা হলো না। পাশাপাশি কর প্রক্রিয়া সহজীকরণ করা দরকার।

রুগ্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে সরকার করদাতাদের টাকা অপচয় করছে। সে জন্য সরকারের উচিত, সার কোম্পানির মতো বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া। ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয়। আর এগুলোর ব্যবস্থাপনা করতে সরকারকে যে সময় ব্যয় করতে হচ্ছে, তা অবকাঠামো নির্মাণ বা সামাজিক সুরক্ষার মতো কাজে ব্যয় করলে অনেক কার্যকর হতো। পাশাপাশি এই টাকা দিয়ে সামাজিক সুরক্ষা জাল আরও বড় করা সম্ভব। সরকারকে এখন এসব ভেবে দেখতে হবে।

লেখক: ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি