মূল সমস্যা দুর্বল বাজেট বাস্তবায়ন

সেলিম রায়হান
সেলিম রায়হান

বাংলাদেশের ভবিষ্যতের বেশ কিছু কঠিন উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার পথের পরিপ্রেক্ষিতে এবারের বাজেট বিষয়ে আলোচনা করা দরকার। প্রশ্ন হচ্ছে, এই রকম বাজেটের মাধ্যমে বাংলাদেশ কি ওই সব উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার পথে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারবে।

নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট একটি ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ বাজেট। উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই অর্থে যে বাজেটের আকার বেশ বাড়লেও তা বাস্তবায়নের স্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা বাজেট বক্তৃতায় নেই। সাম্প্রতিক বছরে বাজেট বাস্তবায়নের দুর্বলতা যেন একটি স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গভীর আলোচনা দেখা যায় না। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার এবং দেশের সামনে যে বিশাল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো রয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্যই বড় আকারের বাজেটের প্রয়োজন আছে। মূল সমস্যার জায়গাটি হচ্ছে দুর্বল বাজেট বাস্তবায়ন। বাজেট বাস্তবায়ন না করতে পারার পেছনে একটি রাজনৈতিক-অর্থনীতিও আছে। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, ৮০ শতাংশের কম বাজেট বাস্তবায়ন করেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার ৭ অথবা ৮–এর ওপরে নিয়ে যাওয়া যায়। এ জন্য মন্ত্রণালয়গুলোও বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সত্যিকার চাপ অনুভব করে না। আশ্চর্যজনকভাবে দেশে বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক সূচকগুলোর দুর্বল সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। বাজেটের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাস্তবায়ন না হলেও দেখা যাচ্ছে, অর্থনীতি শক্তিশালীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খরচ ও সময়—উভয়টিই বেড়ে যাচ্ছে, যা এই প্রকল্পগুলো শেষ করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে এই ধরনের ধীরগতি ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে নিঃসন্দেহে বাধাগ্রস্ত করছে। মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন এ মুহূর্তে কোন অবস্থায় আছে, তা বাজেটে সংযুক্তি হিসেবে দেওয়া যেতে পারত।

মূল কথা হলো, বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেওয়া প্রয়োজন, যেখানে বিদ্যমান সমস্যাগুলো উল্লেখিত থাকবে এবং পাশাপাশি নতুন পরিকল্পনা প্রণয়নের সুযোগ থাকবে। বিগত বছরগুলোর মতো এবারের বাজেটেও এ ধরনের কোনো রোডম্যাপ দেখা যায়নি।

একক হারের প্রাথমিক পরিকল্পনা থেকে সরে এসে সরকার অবশেষে ব্যবসায়ীদের খুশি করার জন্য নতুন ভ্যাট আইনে মূল্য সংযোজন করের চারটি হার প্রস্তাব করেছে। এ রকম কর ব্যবস্থাপনায় সাধারণ জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে এ রকম দুর্বল ভ্যাট ব্যবস্থাপনা ব্যবসায়ীদের ভ্যাট ফাঁকি দিতে উৎসাহিত করবে এবং ভ্যাট আইনের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনকে ব্যাহত করবে। ভ্যাট আইন যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না করা যায়, কর আদায় করার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য যা অর্থমন্ত্রী ভাবছেন আগামী দুই বছরের মধ্যে অর্জন করার, তা সম্ভব নয়।

ব্যাংকিং খাত

দুর্দশায় থাকা ব্যাংকিং খাত নিয়ে যতটা মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল, বাজেটে তা দেওয়া হয়নি। ব্যাংকিং খাতে বিদ্যমান সংকট ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে বড় ধরনের আস্থাহীনতার সৃষ্টি করেছে, যা কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও স্থবিরতার সৃষ্টি করেছে। আমরা যদি এখনই এই বিষয়গুলো যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় না আনি এবং যথোপযুক্ত পদক্ষেপ না নিই, তাহলে আমাদের জন্য ভবিষ্যতে সংকটময় সময় অপেক্ষা করছে। ব্যাংকিং খাতের সংকট অনেক দিন ধরে চলমান কাঠামোগত সমস্যার ফল। এই খাতে অত্যধিক মাত্রায় অনাদায়ি ঋণ রয়েছে। দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যবেক্ষণ ব্যাংকিং খাতের একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা সমর্থিত অনিয়মের কোনো দৃশ্যমান শাস্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারায় এ সমস্যা আর প্রকট আকার ধারণ করছে। ব্যাংকিং খাতে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা সংকটকে আরও গভীর করবে। একটি নিরপেক্ষ এবং পেশাদারি ব্যাংকিং কমিশন এখন সময়ের দাবি।

বেসরকারি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান

কয়েক বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ একটি স্থবির অবস্থানে রয়েছে, অন্যদিকে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ায় সামগ্রিক জাতীয় বিনিয়োগ বেড়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখতে এবং এর হারকে ত্বরান্বিত করতে বেসরকারি বিনিয়োগে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উন্নতির ধারা কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রবৃদ্ধির ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। সরকারি হিসাবেই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈর্ষণীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রবৃদ্ধির হার যথেষ্ট পরিমাণে শ্লথগতিসম্পন্ন। এ রকম একটি ‘কর্মসংস্থান’ বিমুখ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নানা রকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্য বৃদ্ধি এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে সহায়ক। অতএব, শ্রমবান্ধব প্রযুক্তিনির্ভর খাতসমূহে কীভাবে আরও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যায়, এবং এ ধরনের বিনিয়োগে বাধাসমূহ কীভাবে অপসারণ করা যায়, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

এবারের বাজেটে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ আছে, যেমন যুবকদের মধ্যে সব ধরনের ব্যবসা উদ্যোগ (স্টার্ট আপ) সৃষ্টির জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা। কিন্তু সামগ্রিক ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি, ব্যাংকিং খাতের সংকটের সমাধান এবং অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর দৃশ্যমান ও সময়মতো বাস্তবায়ন ছাড়া ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের বড় ধরনের উন্নতি সম্ভব নয়। এবারের বাজেটে এই তিনটি বিষয়েই শক্তিশালী কোনো অবস্থান চোখে পড়েনি।

ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনা, ভবন নির্মাণে বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রেও বাজেটে কালোটাকা সাদা করার প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি রয়েছে। শাস্তি বা সংশোধনমূলক ব্যবস্থা না রেখে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, এ ধরনের উদ্যোগের খুব বেশি সাফল্যের চিত্র নেই।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। সামনের দিনগুলোতে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রপ্তানি পণ্য বহুমুখী করা। এ ক্ষেত্রে অদ্যাবধি বাংলাদেশের সাফল্য নেই। এবারের বাজেটে বরাবরের মতোই তৈরি পোশাক খাত অন্য যেকোনো রপ্তানি খাতের চেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে। অথচ, রপ্তানি পণ্য বহুমুখী করতে হলে তৈরি পোশাক খাতের চেয়ে অন্যান্য খাতে বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন, প্রস্তাবিত বাজেটে যা অনুপস্থিত।

পরিশেষে, এবারের বাজেটে সবার জন্য পেনশন, সরকারি কর্মচারীদের বিমা, ওয়েলথ ট্যাক্স, যানবাহনের নিবন্ধন কর বৃদ্ধি, রেমিট্যান্সে প্রণোদনা এবং উপজেলা পর্যায়ে এনবিআরের অফিস করার উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে অতীতে নেওয়া অনেক ভালো পদক্ষেপ কেন বাস্তবায়ন করা যায়নি, তার কোনো মূল্যায়ন এখানে নেই। এই মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকাটা জরুরি। তা না হলে অনেক ভালো উদ্যোগই কেবল কথার মধ্যে থেকে যাবে।

যে প্রশ্ন শুরুতে করেছিলাম, এই রকম বাজেটের মাধ্যমে বাংলাদেশ বড় ধরনের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবে কি না। উত্তর হচ্ছে, ওই সব বড় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার জন্য যে ধরনের অসাধারণ প্রয়াস প্রয়োজন, তা বরাবরের মতোই এই বাজেটে অনুপস্থিত। তাই এ ধরনের বাজেটের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নসহ অন্যান্য বড় উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়।

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, সানেম