নানা বাস্তবতায় কিছুটা সমঝোতার বাজেট: নাজনীন আহমেদ

নাজনীন আহমেদ
নাজনীন আহমেদ

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট জিডিপির আকার হিসাবে খুব বড় নয়। কিন্তু কর আদায় ও ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত দুর্বলতা, পাশাপাশি অর্থ ব্যয়ে দক্ষতার অভাবের কারণে রাজস্ব আদায় ও ব্যয় নিয়ে সংশয় রয়েই গেছে। ফলে এই বাজেটের আকার বেশ বড় মনে হচ্ছে। অর্থনীতিতে বিদ্যমান আর্থিক খাতের দুর্বলতা, বেসরকারি বিনিয়োগের শ্লথগতি, অর্থনীতিতে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব, নানা ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব—এসব বাস্তবতায় কিছুটা সমঝোতার বাজেট সরকারকে দিতেই হলো। প্রত্যাশা হচ্ছে, উন্নয়ন ধরে রাখা। তাই দেশীয় নানা শিল্পকে উৎসাহিত করতে কর সুবিধা দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। আবার বিদ্যমান বড় শিল্প খাতের জন্যও নতুন প্রণোদনার প্রস্তাব আছে। যদিও তৈরি পোশাক খাতকে নতুন প্রণোদনা দিতে যে ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন হবে, সেটা কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখতে হবে। প্রণোদনা স্বল্প সময়ের জন্য দেওয়া উচিত।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর আদায় ও ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত দুর্বলতাকে মেনে নিয়ে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের যে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, তা এ বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে যেভাবে ভ্যাটের কাঠামো ঘোষিত হয়েছে, তা ২০১২-এর ভ্যাট আইনের অনেক বাইরে গিয়ে খোলনলচে বদলানো এক অদ্ভুত রূপ নিয়েছে। এরূপ কাঠামো দিয়ে যে জটিলতা দেখা দেবে, তা সরকারের রাজস্ব আদায়ের এই বড় উৎসে চরম অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। তাই প্রস্তাবিত ভ্যাট কাঠামো বাস্তবায়নের আগে আরও বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়া প্রয়োজন।

সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টি। সে পরিপ্রেক্ষিতে ঘাটতি বাজেট পূরণে সরকার যে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে, তা বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে নেতিবাচকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। এই বিরূপ প্রভাব দূর করতে সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত আর্থিক খাতে সমস্যা মোকাবিলার উদ্যোগ জোরদার করতে হবে। খেলাপি ঋণের পুনঃতফসিলের যে নতুন পন্থা ঘোষিত হয়েছে, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও এর বিকল্প ছিল খুব কম। তবে এই নতুন নিয়মে যেসব ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, তা মানার ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। নতুবা আর্থিক খাতের দুর্বলতা আরও প্রকট হতে পারে। ব্যাংক কমিশন গঠন করে খুব লাভ হবে বলে মনে হয় না। বরং খেলাপি ঋণের ব্যাপারে যে রিট আবেদন হয়, তা নিষ্পত্তিতে আদালতে আলাদা বেঞ্চ প্রয়োজন।

বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে বাজেটে ঘোষিত শিল্প-প্রণোদনাগুলো কাজে লাগবে বলে আশা করা যায়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ৫০ লাখ টাকার টার্নওভার পর্যন্ত করমুক্তি ইতিবাচক হবে। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা শুরুর মূলধনে বরাদ্দ রাখার বিষয়টিও ইতিবাচক। এ ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের প্রাধান্য দিতে হবে।

দেশের ইলেকট্রনিক, পোলট্রি, মৎস্য, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি খাতের বিকাশে প্রণোদনাও ইতিবাচক। তবে মোবাইল ফোনে কথা বলার সময়ের ওপর কিংবা স্মার্টফোনের ওপর করারোপ ব্যবসাবান্ধব নয়। অতি উচ্চ মূল্যের স্মার্টফোনে বাড়তি করারোপ করা যায়। কিন্তু ১৫ হাজার টাকার কম মূল্যের কোনো স্মার্টফোনে কর বাড়ানো ঠিক হবে না। কারণ, স্মার্টফোনের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ইন্টারনেট সুবিধা ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাকার নানান সুযোগ-সুবিধা নিতে পারে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর প্রস্তাবনা ইতিবাচক। তবে এ ক্ষেত্রে অপচয় রোধে সব সুবিধাভোগীর প্রাপ্য অর্থ সরাসরি প্রেরণের (তার নিজের বা মনোনীত ব্যাংক হিসাবে) ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

বিদেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের ওপর প্রণোদনা কেবল প্রবাসীদের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় অর্থ প্রেরণে উৎসাহিত করবে তা-ই নয়, বরং এ বাড়তি অর্থ সামগ্রিক চাহিদা বাড়াবে। এতে দেশীয় শিল্পপণ্যের চাহিদা বাড়বে, যা অর্থনীতিকে চাঙা করতে ভূমিকা রাখবে।

উন্নয়ন বাজেটের দুর্বল বাস্তবায়ন এখনো লক্ষণীয়। অর্থবছরের ৯ মাসে ৫৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করে বাকি সময়ে যে তাড়াহুড়ো করা হয়, তাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের মান কমে যায় এবং তা অর্থনীতিতে ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। মেগা প্রকল্পের সময়ানুযায়ী বাস্তবায়নে বারবার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও চলতি অর্থবছরেও এসব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ পুরোপুরি ব্যয় করা যায়নি। তবে অন্য প্রকল্প থেকে এসব প্রকল্পের অগ্রগতি মোটা দাগে ভালো। মনে রাখতে হবে, মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ বেশি হলে তা মেগা অপচয় ঘটাবে।

সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন পূরণে বাজেট বরাদ্দ মনে করিয়ে দেয় যে সরকারি মালিকানাধীন যেসব প্রতিষ্ঠান এসব ব্যাংকের ঋণ শোধ করছে না, তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ জরুরি। এসব প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতার জের টানতে হচ্ছে সাধারণ মানুষের করের টাকায়।

প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকা সাদা করার জন্য যে সুযোগ রাখা হয়েছে, তা কাম্য নয়। এতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি বা দেশে টাকা রাখার পরিকল্পনা খুব একটা সফল হবে বলে মনে হয় না। অর্থের উৎসের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করার ক্ষমতা দুর্নীতি দমন কমিশনে থেকে যাওয়ায় বড় কালোটাকার মালিকেরা এতে আসবেন না। অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো একটি বিশেষ সুবিধাবহুল শিল্প এলাকায় অসৎ ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকার বা সুযোগ দিলে সৎ ব্যবসায়ীরা বঞ্চিত হবেন। তা ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পকারখানা থাকলেই কাউকে সরাসরি কালোটাকার মালিক বলে মনে হওয়ার যে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব, তা সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করবে।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটটি বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে উন্নয়নের প্রচেষ্টায় প্রস্তাবিত হলেও ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের জটিলতা, রাজস্ব আদায়ের কাঠামোগত দুর্বলতা, ব্যয়ের দক্ষতা বৃদ্ধির দুর্বলতা—সব মিলিয়ে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এর বাস্তবায়নে সরকারকে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে।