চাপ বাড়াবে ভ্যাট আইন

নতুন ভ্যাট আইন জীবনযাত্রার খরচ বাড়িয়ে দিতে পারে। বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনার পাশাপাশি সেবা নিতে গেলে আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হবে। আবার ব্যবসায়ীদের পণ্য ও সেবা আমদানি ও সরবরাহে খরচও কিছু ক্ষেত্রে বেড়ে যেতে পারে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, একাধিক ভ্যাট হার করলেও নতুন আইনটি ব্যবসায়ীদের কঠিন শর্তের বেড়াজালে ফেলে দেবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা ধরনের শর্ত দেওয়া হয়েছে। যেমন এবার অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাটের (এটিভি) পরিবর্তে ৫ শতাংশ আগাম কর (এটি) বসানো হয়েছে। ভ্যাট রিটার্ন দিয়ে এই আগাম করের টাকা ফেরত নিতে হবে। এই টাকা ফেরত পাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে ব্যাংকের সুদ গুনতে হবে ওই ব্যবসায়ীকে। ভ্যাটের টাকা ফেরত পাওয়ার দীর্ঘ প্রক্রিয়া ও সুদের বাড়তি টাকা—যা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে।

আবার ২৫ হাজার টাকার বেচাকেনা হলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের ভ্যাটের নিবন্ধন থাকতে হবে। পণ্য বা সেবার মূল্য ঘোষণা উঠিয়ে দেওয়ায় বাজারমূল্যে ভ্যাট দিতে হবে। এতে সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম ঘোষণা দিলে চাপে পড়বেন শেষ পর্যন্ত ভোক্তারাই।

ভ্যাট হারের দিক থেকে নতুন আইনের সঙ্গে পুরোনো আইনের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। নতুন ভ্যাট আইনে পুরোনোটির মতো একাধিক ভ্যাট হার আছে। এ ছাড়া পুরোনো আইনের মতো সুনির্দিষ্ট কর আছে। আছে অগ্রিম ভ্যাটও। নেই শুধু প্যাকেজ ভ্যাট। ভ্যাট কর্মকর্তাদের ক্ষমতাও আগের মতোই রাখা হয়েছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ, তল্লাশি এবং প্রয়োজনে পণ্য ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে পারবেন।

আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হবে। এর আগে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে বাস্তবায়নের কথা ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে তা দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

নতুন আইনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর বিষয়ে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মওলা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্যাকেজ ভ্যাট দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম। কারওয়ান বাজার, মৌলভীবাজারের পরিবেশ এখনো ইউরোপের মতো নয় যে ইসিআর মেশিন ব্যবহার করব। নতুন আইনের জটিল ও কঠিন হিসাব–নিকাশ করতে এখন আমাদের হিসাববিদ রাখতে হবে। এনবিআরের কাছ থেকে আগাম করের টাকা ফেরত নিতেও নানা ভোগান্তি পোহাতে হবে। রেয়াত নেওয়ার সুযোগ না থাকায় সার্বিকভাবে নতুন ভ্যাট আইনে পণ্যের দাম বাড়াবে।’

 দাম বাড়বে, কমবে

দেশি ব্র্যান্ডের দোকান থেকে পোশাক কিনলে আগে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হতো। এখন সেই ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ। এমনকি ব্র্যান্ড নয়, এমন দোকানে গেলেও দিতে হবে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে ভ্যাট। অর্থাৎ ১ হাজার টাকার পোশাক কিনলে ৫০ টাকার পরিবর্তে ভ্যাট দিতে হবে ৭৫ টাকা।

পাঠাও-উবারে উঠলেও খরচ বাড়তে পারে। রাইড শেয়ারিংয়ের জন্য কোনো গাড়ির মালিক উবার-পাঠাওয়ে নিবন্ধন নেন, যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়ার একটি অংশ উবার-পাঠাও কর্তৃপক্ষকে দেন। আগে উবার–পাঠাওকে ভাড়ার যে অংশ দেওয়া হতো, সেই অংশের ওপর ৫ শতাংশের পরিবর্তে কাটা হবে সাড়ে ৭ শতাংশ।

নির্মাণ খাতের রডের ওপর ভ্যাট এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। এতে ফ্ল্যাট, বাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের ভৌত উন্নয়নের প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেবে। এ ছাড়া যেসব পণ্য বা সেবার দাম বাড়তে পারে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আসবাব, নিলাম পণ্য, তৈরি পোশাক, অ্যামিউজমেন্ট পার্কের মাশুল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভার্চ্যুয়াল বিজনেসের মাধ্যমে বিক্রি করা পণ্য।

কিছু পণ্য বা সেবার দাম কমতে পারে। যেমন সিনেমা দেখতে গেলে টিকিটের ওপর ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। বইপত্র ছাপানোর সেবার ওপর একই হারে ভ্যাট কমানো হয়েছে। আবার ভ্যাট ১৫ থেকে ১০ শতাংশ করার ফলে বোর্ড সভায় অংশগ্রহণের সম্মানীর টাকা হাতে বেশি আসবে। দাম কমার তালিকায় আছে সিকিউরিটি সেবা, লন্ড্রি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সেবা।

একাধিক হার

২০১২ সালের মূল আইনে ভ্যাট হার ছিল একক ১৫ শতাংশ। কিন্তু ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে একক ভ্যাট হারের পরিবর্তে এখন সব মিলিয়ে ভ্যাট হার আটটি। এগুলো হলো ২ শতাংশ, ২ দশমিক ৪ শতাংশ, ৩ শতাংশ, সাড়ে ৪ শতাংশ, ৫ শতাংশ, সাড়ে ৭ শতাংশ, ১০ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ। শুধু ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিলেই রেয়াত মিলবে।

নতুন ভ্যাট আইন অনুযায়ী পেট্রোলিয়াম পণ্যে ২ শতাংশ, ওষুধে ২ দশমিক ৪ শতাংশ ভ্যাট আছে। এ ছাড়া ভূমি উন্নয়ন সংস্থার সেবার ওপর ৩ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। ১৬০০ বর্গফুটের কম ফ্ল্যাট নিবন্ধনে ৩ শতাংশ এবং ১৬০০ বর্গফুটের বেশি হলে সাড়ে ৪ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। ফ্ল্যাট পুনর্নিবন্ধনে ভ্যাট ২ শতাংশ। ৬৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ৫ শতাংশ এবং ২০ ধরনের সেবার ওপর ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট আছে। রড, ইট, নিউজপ্রিন্ট আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।

৫০ লাখ টাকা বার্ষিক লেনদেন হলে ওই প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের আওতার বাইরে থাকবে। টার্নওভার কর ৩ থেকে বাড়িয়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। সীমা হলো বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা। একজন ব্যবসায়ীর দৈনিক লেনদেন ১৩ হাজার ৭০০ টাকা হলেই বার্ষিক লেনদেনের ওপর টার্নওভার কর দিতে হবে। রেস্তোরাঁ, মুদিদোকান, ছোটখাটো হোটেল, মিষ্টির দোকান, বিউটি পারলার, রেন্ট–এ–কার, মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রদানকারী এজেন্ট—এসব ছোট ব্যবসায়ী টার্নওভার করের আওতায় চলে আসতে পারেন। কর এড়াতে তাঁরা লেনদেন কমিয়ে দেখাতে উৎসাহী হবেন।

এটিভির পরিবর্তে আগাম কর

৫ শতাংশ অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাট (এটিভি) উঠিয়ে আমদানি পর্যায়ে ৫ শতাংশ আগাম কর বসানো হয়েছে। তবে আগাম কর ফেরত পেতে আমদানিকারকের ভ্যাট রিটার্ন দিয়ে আমদানি–পরবর্তী পর্যায়ে যে ভ্যাট দেবে, তা সমন্বয় করতে পারবেন। যে ব্যক্তি আগাম কর পরিশোধ করেছেন, কিন্তু ভ্যাট নিবন্ধিত হওয়ার শর্ত নেই, তাঁরা কমিশনারের কাছে আবেদন করলে আগাম করের টাকা ফেরত পাবেন।

আগাম করের প্রভাব এরই মধ্যে পড়েছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে। আমদানি পণ্যের ওপর আগাম কর কেটে রাখা হচ্ছে বলে মসলা, গম, মটর, ছোলা, মসুর ডালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক ও ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, একেক জাহাজ গমে চার-পাঁচ কোটি টাকা আগাম কর দিতে হবে। এই টাকা ফেরত পাওয়া পর্যন্ত ব্যাংকের সুদ দিতে হবে। এর প্রভাব পণ্যের দামে পড়বেই।

 মূল্য ঘোষণা নেই

এত দিন পণ্যের নির্ধারিত মূল্য এনবিআরের কর্মকর্তাদের দিয়ে অনুমোদন নেওয়ার সুযোগ ছিল। ভ্যাট হতো সেই মূল্যের ওপর। নতুন আইনে ব্যবসায়ীরা নিজেই বাজারদর অনুযায়ী মূল্য ঘোষণা করবেন, সেই মূল্যের ওপর ভ্যাট আরোপ হবে। দাম বাড়লে ভ্যাট বেশি পাওয়া যাবে, দাম কমলে ভ্যাটের আদায় কমে যাবে। এ ছাড়া ভ্যাট ফাঁকি দিতে পণ্যের মূল্য কম দেখানোর সুযোগও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বাড়তে পারে। তবে এনবিআর বলছে, কম মূল্য দেখালে ভবিষ্যতে ধরা পড়বে। তবে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মূল্য কম ঘোষণা করলে তা ঠেকানোর উপায় নেই।

নতুন আইনে ২৫ হাজার টাকার বেশি কোনো পণ্য বা সেবার লেনদেন হলেই বিক্রেতা ও গ্রহীতা উভয়ের ইলেকট্রনিক ব্যবসায় শনাক্তকরণ নম্বর (ইবিআইএন) থাকতে হবে। চালানপত্রে ইবিআইএনের উল্লেখ থাকতে হবে। এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত ২৫ হাজার টাকার বেশি লেনদেন করে প্রতিষ্ঠানগুলো। তাই উভয়ের ইবিআইএন নিশ্চিত করতে এই শর্ত আরোপ করা হয়েছে।

নতুন আইন সম্পর্কে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি ভালো আইনকে নষ্ট করা শুরু করেছি মাত্র। একক ভ্যাট হারের পরিবর্তে আটটি হার করা হয়েছে। প্যান্ডোরার বাক্স খোলা হলো মাত্র। ক্ষমতাশালীরা প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের মতো করে আরও ভ্যাট হার আদায় করে নেবে। তাঁর মতে, নতুন আইনের কঠিন শর্ত পালন করতে পারবেন না অনেক ব্যবসায়ী। এতে ভ্যাট ফাঁকি বাড়বে, আবার পণ্যের দামও বেড়ে যাবে।