বিনিয়োগ কমবে, টাকা যাবে বিদেশে

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

এবারের বাজেটে বিদেশি বিনিয়োগের ওপরও করারোপ করা হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিটেইনড আর্নিংস বা রিজার্ভের ওপর যে কর প্রস্তাব করা হয়েছে, এটি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন এ দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বহুজাতিক কোম্পানির শীর্ষ নির্বাহীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮ সালে দেশে ৩৬১ কোটি মার্কিন ডলার বা সাড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। তার মধ্যে মূলধন বিনিয়োগের পরিমাণ ১১২ কোটি ডলার। আর পুনর্বিনিয়োগের পরিমাণ ১৩১ কোটি ডলারের। বহুজাতিক কোম্পানির নির্বাহীরা বলছেন, পুনর্বিনিয়োগের প্রায় পুরোটাই করা হয়েছে কোম্পানির রিজার্ভ বা রিটেইনড আর্নিংস থেকে। এখন রিটেইনড আর্নিংসের ওপর কর দিতে হলে পুনর্বিনিয়োগ কমে যাবে। তাঁরা আরও বলছেন, এ কর এড়াতে অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান রিজার্ভের অর্থ শেয়ারধারীদের লভ্যাংশ হিসেবে দিতে পারে। তাতে লভ্যাংশের বড় একটি অংশ দেশ থেকে বাইরে চলে যাবে। এতে দেখা যাবে, যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ দেশে এসেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বৈধ পথে বিদেশে চলে যাবে।

>

বেশি রিজার্ভে বেশি কর
বিদেশি বিনিয়োগের বড় অংশই আসে রিজার্ভ থেকে পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে
করারোপের কারণে তা লভ্যাংশ হিসেবে বিদেশে চলে যেতে পারে

বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে ১২টি। এগুলো হলো গ্রামীণফোন, বার্জার বাংলাদেশ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, সিঙ্গার বিডি, রেকিট বেনকাইজার, লাফার্জহোলসিম, ম্যারিকো, আরএকে সিরামিক, গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন, লিনডে বিডি, বাটা শু এবং হাইডেলবার্গ সিমেন্ট। এসব কোম্পানির সিংহভাগ মালিকানাই রয়েছে বিদেশিদের হাতে। তাতে প্রতিবছর কোম্পানিগুলো যে লভ্যাংশ ঘোষণা করে, তার সিংহভাগই চলে যায় বিদেশে। বিদেশি মালিকদের কাছে সহজে মুনাফা দিতে এমনিতেই কোম্পানিগুলো নগদ লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। আবার বছর বছর মুনাফার একটি অংশ কোম্পানিগুলো রেখে দেয় পুনর্বিনিয়োগের জন্য, যাতে ব্যবসা সম্প্রসারণে উদ্যোক্তাদের নতুন করে অর্থ বিনিয়োগ করতে না হয়। তাই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগের রিজার্ভ পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে ২ থেকে ৩০ গুণ পর্যন্ত বেশি।

বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিটেইনড আর্নিংস, রিজার্ভ ইত্যাদির সমষ্টি যদি সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে যতটুকু বেশি হবে, তার ওপর সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে ১৫ শতাংশ বাড়তি কর দিতে হবে। এ ছাড়া কোনো কোম্পানি বোনাস লভ্যাংশ দিলে তাকে ঘোষিত লভ্যাংশের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে।

উদ্যোক্তারা বলছেন, এটি কার্যকর হলে কোম্পানিগুলো একদিকে যেমন দ্বৈত করের চাপে পড়বে, অন্যদিকে ব্যবসা সম্প্রসারণ ব্যাহত হবে। পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা হিসেবে এ দুটি করারোপের প্রস্তাব করা হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আদতে এটি প্রণোদনা নয়, একধরনের শাস্তি। এর পরিবর্তে কোম্পানিগুলোকে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণায় উৎসাহিত করতে কর ছাড়ের বিধান করা যেত। কিন্তু কর ছাড়ের বিধান না করে যাঁরা বোনাস ও রিজার্ভের ওপর কর প্রস্তাব করেছেন, তাঁরা এর বাস্তব প্রভাব কী হতে পারে, তার মূল্যায়ন করেননি।

ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ফিকি) সভাপতি ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেহজাদ মুনিম প্রথম আলোকে বলেন, সরকার বাজেটে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির রিজার্ভের ওপর করারোপের যে প্রস্তাব করেছে, সেটি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের ওপর করারোপের শামিল। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশে যে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে, তার বড় অংশ আসছে পুনর্বিনিয়োগ হিসেবে। তিনি আরও বলেন, এটি কার্যকর হলে রিজার্ভের বড় অংশ থেকে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে দিতে পারে কোম্পানিগুলো। সে ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ লভ্যাংশ হিসেবে বিদেশে চলে যাবে। তাতে বছর শেষে হিসাব করলে দেখা যাবে, যে পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ দেশে এসেছে, তার চেয়ে বেশি লভ্যাংশ হিসেবে বিদেশে চলে গেছে।