বছর যায়, লোকসান বাড়ে

ব্যবসা করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনছে সরকার। জনগণের করের টাকায় কারখানাগুলো বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সরকারের কলকারখানাগুলো নিট লোকসান গুনেছে ২ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা।

সরকারের কলকারখানা পরিচালনার জন্য ছয়টি করপোরেশন আছে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ বস্ত্রকল করপোরেশন (বিটিএমসি) ও বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি) এক যুগ ধরেই লোকসান গুনছে। টানা আট বছর ধরে লোকসানের খাতায় আছে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)। গত চার বছরে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) মুনাফার মুখ দেখেনি। বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি) নতুন করে লোকসানে পড়েছে। লাভে আছে শুধু বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি)। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৯ অনুযায়ী, গত ছয় বছরে করপোরেশনগুলোর নিট লোকসান হয়েছে ৯ হাজার ১৩১ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মুনাফা করলেও করপোরেশনের অধীনে থাকা বেশির ভাগ কারখানা সেটি পারছে না। সে জন্য সরকারকে বছরের পর বছর লোকসানের দায় নিতে হচ্ছে। আর প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখতে জনগণের করের টাকা দিয়ে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, দুর্নীতি ও পরিচালন অদক্ষতার কারণে করপোরেশনগুলো লোকসান গুনছে। এ জন্য সরকারের আর্থিক দায় বাড়ছে। তবে লোকসান গুনতে থাকা কয়েকটি করপোরেশন বন্ধ করার সময় এসেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত একটি উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের মাধ্যমে সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে করপোরেশনের কার্যক্রম বন্ধ, সীমিত ও বিকল্প শিল্পায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা

বিজেএমসির অধীনে ২৫টি পাটকল আছে। যার মধ্যে তিনটি নন-জুট। বাকি ২২টি পাটকলের সব কটিই লোকসানে রয়েছে। অর্থাভাবে পাটকলের মজুরি পরিশোধে প্রায় প্রতিবছরই সংকট তৈরি হয়। সর্বশেষ ঈদের আগে পাটকলশ্রমিকেরা মজুরি ও ভাতার জন্য আন্দোলনে নামলে সরকার ১৬৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা দেয়।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, গত এক যুগে কখনোই মুনাফা করতে পারেনি বিজেএমসি। গত ছয় বছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিট লোকসান গুনেছে করপোরেশনটি। তার মধ্যে গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান ছিল ৪৯৭ কোটি টাকা। চলতি ২০১৮–১৯ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই সেটি বেড়ে ৬৯৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

বিজেএমসির মতো গত এক যুগে লাভের মুখ দেখেনি বিটিএমসিও। গত ছয় বছরে তাদের নিট লোকসান ১৩৭ কোটি টাকা। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে করপোরেশনটির লোকসান ছিল ১৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) সেটি ২৪ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ১২টি কারখানায় সার, কাগজ, সিমেন্ট, স্যানিটারি ওয়্যার ও গ্লাসশিট উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিসিআইসির নিট লোকসান ছিল ৫৫৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সেই লোকসান ৬৪ শতাংশ বেড়ে ৯১১ কোটি ৪৩ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে গত চার অর্থবছরে তাদের নিট লোকসানের পরিমাণ ২ হাজার ২৬ কোটি টাকা।

বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) শাহজালাল ফার্টিলাইজার, ইউরিয়া ফার্টিলাইজার, কর্ণফুলী পেপার মিল, আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল, ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি, পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার, বাংলাদেশ ইনস্যুলেটর অ্যান্ড স্যানিটারি ফ্যাক্টরি ও উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি ৪৭৩ কোটি টাকা লোকসান করেছে। একই সময়ে যমুনা ফার্টিলাইজার, টিএসপি কমপ্লেক্স ও চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার মুনাফা করেছে ১৫৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অধীনে থাকা ১৮টি কারখানার মধ্যে লাভে আছে মাত্র দুটি। এ দুটিতে আবার চিনি উৎপাদিত হয় না। চিনিকলের মধ্যে একটিও লাভে নেই। বিএসএফআইসি গত এক যুগে কখনোই মুনাফা করতে পারেনি। গত ছয় বছরে ৪ হাজার ৬৬ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। এর মধ্যে গত অর্থবছরে তাদের লোকসানের পরিমাণ ছিল ৮৩৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সেটি বেড়ে প্রায় ৯৮২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

সরকারের ছয়টি সংস্থার মধ্যে কেবল লাভে আছে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি)। অন্যদিকে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফআইডিসি) দীর্ঘদিন লাভে থাকলেও চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সেটি লোকসানে চলে গেছে।

জানতে চাইলে আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষ খুব কষ্ট করে কর দেন। সেই টাকা লোকসানি কলকারখানার পেছনে নষ্ট করাটা অন্যায়। লোকসান গুনতে থাকা কলকারখানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। এতে সরকার ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক।