বাজেট বিনিয়োগবিরোধী ব্যবসার খরচ বাড়াবে

দেশি এবং বিদেশি—উভয় ধরনের বিনিয়োগকেই নিরুৎসাহিত করবে প্রস্তাবিত বাজেট। নতুন বাজেটে এমন সব ধারা যুক্ত করা হয়েছে, যেগুলো আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দেবে, ব্যবসায়ের খরচও বাড়াবে।

জাতীয় সংসদে ১৩ জুন ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আর এ বাজেট নিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এমন পর্যবেক্ষণই তুলে ধরেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন সংস্থা বিডা পর্যবেক্ষণসংবলিত প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে পাঠিয়েছে। প্রতিবেদনে বিনিয়োগের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে।

যোগাযোগ করলে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন করে কিছু বলতে চাই না। যা বলার আমরা প্রতিবেদনেই বলেছি। এগুলো মানা বা বাস্তবায়নের দায়িত্ব এখন সরকারের।’

বাজেট পাসের আগে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) আরেকবার তাদের মতামত জানাবে। তাই বাজেট নিয়ে বিডার মূল্যায়ন এফবিসিসিআইয়ের কাছেও পাঠানো হয়েছে বলে জানান কাজী আমিনুল ইসলাম।

বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী সহজে ব্যবসা করার সূচকে (ইজ অব ডুয়িং বিজনেস) বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ১৯০ দেশের মধ্যে ১৭৬ তম, প্রস্তাবিত বাজেট সেই অবস্থানকে আরও পিছিয়ে দেবে বলে আশঙ্কা বিডার। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে সহজে ব্যবসা করার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০-এর নিচে নামিয়ে আনা।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে এমন কোনো আশার কথা শোনানো হয়নি যে দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবেন। এরই মধ্যে যাঁরা বিনিয়োগ করেছেন, উল্টো তাঁদের জন্য অসুবিধা হওয়ার মতো পদক্ষেপই নেওয়া হয়েছে।

জাহিদ হোসেন বলেন, করপোরেট কর কমিয়ে বিনিয়োগবান্ধব হওয়ার সুযোগ ছিল—অর্থমন্ত্রী তাতে হাতই দেননি। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে নগদ লভ্যাংশ দিতে বলা হয়েছে, এটিও বিনিয়োগবিরোধী পদক্ষেপ। কারণ, এতে কোম্পানির তারল্যসংকট হবে। রিটেইন্ড আর্নিংয়ের ওপর যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা একেবারেই ভুল পদক্ষেপ।

ব্যয় হয়ে যাবে আয়
প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশের ১৯ উপধারায় নতুন একটি বিষয় সংযোজন করে বলা হয়েছে, মূলধনি যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন করা না হলে মূলধনি যন্ত্রপাতি কেনার জন্য যত টাকা ব্যয় হবে, তা আয় হিসেবে গণ্য হবে।

বিষয়টি উল্লেখ করে বিডা বলেছে, বিনিয়োগকারীরা সব সময় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় অজ্ঞতা বা আইনগত অস্পষ্টতার কারণে উৎসে কর কর্তন এবং তা জমা সময়মতো না-ও হতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে আয়কর কর্তৃপক্ষ দাবিনামা জারির মাধ্যমে সুদসহ কর কর্তন ও জরিমানা আরোপ করে থাকে। এর পাশাপাশি অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে মূলধনি যন্ত্রপাতি কেনায় ব্যয় করা অর্থকে আয় হিসেবে গণ্য করা অযৌক্তিক।

উদাহরণ দিয়ে বিডা বলেছে, এক কোটি টাকা মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ৫ শতাংশ উৎসে কর হলে ৫ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। কেউ তা দিতে না পারলে এক কোটি টাকাকে আয় ধরে নিয়ে সরকার তাঁর কাছ থেকে ৩৫ লাখ টাকা বাড়তি আয়কর আদায় করবে। নতুন এ ব্যবস্থা লঘুপাপে গুরুদণ্ডের শামিল এবং বিনিয়োগবিরোধী।

লাইসেন্স ফি ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি
আয়কর অধ্যাদেশের ৫২কে ধারা সংশোধন করে ট্রেড লাইসেন্সের নবায়ন ফি (মাশুল) ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৩ হাজার টাকা, অন্যান্য সিটি করপোরেশনে ৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ হাজার টাকা, জেলা সদরের পৌরসভায় ৩০০ থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা এবং অন্যান্য পৌরসভায় ১০০ থেকে বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে।

নতুন হারের কারণে ব্যবসায়ের খরচ বাড়বে এবং ব্যবসায়ের পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই হার কার্যকর হলে বিশ্বব্যাংকের ব্যবসা শুরুর সূচকে ব্যয় বাড়বে অন্তত ১ দশমিক ৩ শতাংশ।

কর রেয়াতের অযৌক্তিক শর্ত
মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আইনের ৪৬ (১) (ক) ধারায় বলা হয়েছে, করযোগ্য সরবরাহের মূল্য যদি এক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায় এবং তা যদি ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে পরিশোধ করা না হয়, তাহলে কোনো ব্যবসায়ী উপকরণ কর রেয়াত পাবেন না।

বিডা বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছে, পণ্য উৎপাদনে কাঁচামাল কেনার ক্ষেত্রে মূসক প্রমাণপত্র ঠিক থাকলেই কর রেয়াত পাওয়া উচিত। ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়নি, শুধু এ কারণে কর রেয়াত না দেওয়ার যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, দেশের আর্থিক বাস্তবতা বিবেচনায় অনেক সময় ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন সম্ভব না-ও হতে পারে।

সরকারি কোষাগারে কর জমা দেওয়ার প্রমাণপত্র থাকলেও কর রেয়াত পাওয়া যাবে না, এমন বিধান ব্যবসাবান্ধব নয় এবং তা কার্যকর হলে বিনিয়োগ পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হবে।

আরেকটি ধারায় কর রেয়াত নেওয়ার সময়সীমা সংশ্লিষ্ট কর মেয়াদ বা পরের দুই কর মেয়াদ। বিডা বলেছে, এটাও বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, কোনো কারণে ব্যবসায়ের উৎপাদন বন্ধ থাকলে বা অন্য কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর রেয়াত নেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। এ প্রস্তাব কার্যকর হলেও বিনিয়োগ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ব্যাংক হিসাব অপরিচালনযোগ্যের প্রস্তাব
মূসক আইনের ৮৩ ধারা সংশোধন করে বলা হয়েছে, মূসক আইন বা এই আইনের আওতার বলে তৈরি বিধি লঙ্ঘনের দায়ে লঙ্ঘনকারীর ব্যাংক হিসাব অপরিচালনযোগ্য বা ফ্রিজ করার ক্ষমতা পাবেন সরকারি কর্মচারীরা। সহকারী কমিশনার বা সহকারী পরিচালক বা তাঁর ওপরের পদের কর্মচারীরা এ ক্ষমতার চর্চা করবেন।

বিডা বলেছে, কোনো কর দাবি সৃষ্টি ও দাবিনামা জারি ছাড়া বিধিবিধান লঙ্ঘনের দায়ে কারও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার মতো অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঢালাও ক্ষমতা দেওয়া উচিত হবে না। এতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মনে সংশয় সৃষ্টি হবে এবং দেশের বিনিয়োগ পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়বে।

স্বাভাবিক কাজের অস্বাভাবিক পুরস্কার
মূসক আইনের ১২৬ (খ) (১) (খ) ধারায় পুরস্কার ও কর্মদক্ষতা প্রণোদনা তহবিল নামে একটি হিসাব সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তহবিলের আকার হবে আদায়কৃত মোট কর রাজস্বের (ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক) শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ।

>

বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসার সূচকে অবস্থান আরও খারাপ হতে পারে
ট্রেড লাইসেন্স ফি ৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি খরচ বাড়াবে
স্বাভাবিক কাজের জন্যও অস্বাভাবিক পুরস্কারের ব্যবস্থা
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিনিয়োগ পরিবেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যাবে

এ কথা উল্লেখ করে বিডা বলেছে, সরকারি কর্মচারী হিসেবে মূসক সংগ্রহ করাই যাঁদের দায়িত্ব, তা পালনের জন্য রাজস্বের একটা অংশ আদায়কারীদের পুরস্কার হিসেবে দিয়ে দেওয়া হবে। অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অন্য দুই বিভাগ অর্থাৎ আয়কর বিভাগ ও শুল্ক বিভাগের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধানের কথা বলা হয়নি। সরকারি দায়িত্ব পালনের জন্য মূল রাজস্ব থেকে এভাবে টাকা দেওয়া কোনোভাবেই যৌক্তিক বা আইনানুগ হবে না। বিডা এই প্রস্তাব বাতিলের পক্ষে।

আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৭ কোটি টাকা মূসক সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। সে হিসাবে প্রণোদনা তহবিলের আকার হবে ৬০০ কোটি টাকার বেশি, যার একটা অংশ মূসক সংগ্রহকারীরা পেয়ে যাবেন।

এক ভুলে একাধিক দণ্ড
অর্থ বিলের আয়কর অংশে ৩০বি ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর কর্তনের ব্যর্থতার কারণে সম্পূর্ণ খরচকে আলাদাভাবে আয় হিসেবে দেখা হবে এবং তার ওপর কর আরোপের ব্যবস্থা করা হবে।

উৎসে কর কর্তন ও জমা সময়মতো না হলে আয়কর কর্তৃপক্ষ দাবিনামা জারির মাধ্যমে সুদসহ প্রযোজ্য কর আদায় ও জরিমানা আরোপ করতে পারবে। আগে দাবি করা খরচকে অগ্রাহ্য করে আয়ের সঙ্গে যোগ করার বিধান ছিল, আলাদাভাবে আয় হিসেবে বিবেচনা করে কর আরোপ করা হতো না।

বিডার মতে, নতুন প্রস্তাবটি আয়কর আরোপের মৌলিক সিদ্ধান্তের পরিপন্থী এবং এতে একই ভুলের জন্য একাধিক দণ্ডের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। আবার কোম্পানির ক্ষতি থাকলেও আলাদাভাবে বাড়তি কর পরিশোধ করতে হবে, যা বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

একই আয়ে দুবার কর
আয়কর অধ্যাদেশের ১৬-এ একটি ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানি লভ্যাংশের ওপর ১৫ শতাংশ আয়কর দেবে। আরেকটি ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, রিটেইন্ড আর্নিং, রিজার্ভ ও অন্যান্য ইক্যুইটি যদি পরিশোধিত মূলধনের ৫০ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে বাড়তি অঙ্কের ওপর ১৫ শতাংশ হারে আয়কর আরোপ করা হবে।

বিডা বলেছে, কোম্পানির মুনাফার ওপর আয়কর পরিশোধের পর বাকি অর্থ থেকে বিনিয়োগকারীদের নগদ লভ্যাংশ দেওয়া হয়। এরপর যা থাকে, কোম্পানি তা রাখে রিটেইন্ড আর্নিং (মুনাফা থেকে সঞ্চিতি) হিসেবে। কোম্পানি এই সঞ্চিতি বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণে ব্যয় করে। নগদ লভ্যাংশের পরিবর্তে কোম্পানি অনেক সময় বোনাস শেয়ারও দেয় বিনিয়োগকারীদের।

কর প্রদত্ত রিটেইন্ড আর্নিং থেকে ঘোষিত বোনাস শেয়ারের বিপরীতে আয়কর আরোপ করা হলে তা একই আয়ের ওপর দুবার কর আরোপের ঘটনা ঘটবে।

বিডা আরও বলেছে, কোম্পানি তার স্বার্থে রিজার্ভ সৃষ্টি করতে পারে। আবার অন্যান্য ইক্যুইটির মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক (প্রেফারড) শেয়ার থাকে, যা কোম্পানির মূলধনের অন্তর্ভুক্ত। সরাসরি মূলধনের অংশ হওয়ার কারণে এর ওপর কর আরোপ যৌক্তিক নয়। দুটি নতুন ধারা সংযোজনে নতুন বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত হতে নিরুৎসাহিত হবে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘বিডা যদি এ রকম মূল্যায়ন করে থাকে যে প্রস্তাবিত বাজেট বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং ব্যবসায়ের খরচ বাড়িয়ে দেবে, আমি এর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। বিডা বাস্তবে আমাদের কথাই বলেছে।’

আবুল কাসেম খান বলেন, ‘বিনিয়োগে আমরা দীর্ঘ বছর একই জায়গায় আটকে আছি। প্রস্তাবিত বাজেট তা থেকেও পিছিয়ে দেবে। কারণ, প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, দেশি-বিদেশি কোনো বিনিয়োগকারীরই তাতে উৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’