কর-জিডিপি অনুপাতে তলানিতে বাংলাদেশ

দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, গোটা বিশ্বেই বাংলাদেশের কর-জিডিপি হার নিম্নতম পর্যায়ের। বাংলাদেশের এই হার প্রতিবেশী দেশ নেপালের অর্ধেকের চেয়েও কম। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের অবস্থাও এদিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের এ পরিস্থিতিকে লজ্জাজনক ও উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন।

 জাতীয় সংসদে ১৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট উপস্থাপনের সময় মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিও প্রকাশ করেছেন। নীতি বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গত এপ্রিলে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের প্রতিবেদনকে বিশ্লেষণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। পাঁচ বছরের কর-জিডিপি অনুপাতের চিত্র তুলে ধরে নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ছিল গড়ে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ বিশ্বের উদীয়মান দেশ ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ হার বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি অর্থাৎ ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এমনকি সাব-সাহারা আফ্রিকার দেশগুলোর কর-জিডিপি হারও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

কর-জিডিপি হারে নিকটতম প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও বাংলাদেশের তুলনা করা হয়েছে। আইএমএফের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের গড় কর-জিডিপি অনুপাত নেপালের ২৩ দশমিক ৩, ভারতের ২০ দশমিক ৩, পাকিস্তানের ১৫ দশমিক ২ এবং শ্রীলঙ্কার ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দেশের কর-জিডিপি হার লজ্জাজনক ও বিব্রতকর। এই নিম্নতম হারের কারণেই জাতিসংঘঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করা সহজ হবে না, প্রয়োজন অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। তিনি মনে করেন, কর-জিডিপি অনুপাত কম হওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধনীর কাছ থেকে আয়কর না নেওয়া।

ধনীদের কাছ থেকে কর না-নেওয়া ইচ্ছেকৃত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ইচ্ছে করেই আদায় করা হচ্ছে না। সরকার ইতস্তত বোধ করে।’

পিছিয়ে বাংলাদেশ

সংসদে উপস্থাপিত নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এক দশক ধরে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সত্ত্বেও রাজস্ব আহরণে আশানুরূপ সাফল্য অর্জনে বাংলাদেশ পিছিয়ে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় আঞ্চলিক এবং বহির্বিশ্বের সমতুল্য দেশগুলো যে হারে রাজস্ব আহরণ করতে পারছে, বাংলাদেশ তা পারছে না।

রাজস্ব আদায়ের গতিধারা বিষয়ে বলা হয়, পাঁচ বছরে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য উত্থান-পতন হয় এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরের পর থেকে প্রবৃদ্ধির ঊর্ধ্বগামী প্রবণতা কমে যায়। ওই অর্থবছরের পর থেকে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা এবং প্রকৃত রাজস্ব আহরণের মধ্যে পার্থক্য বড় করে চোখে পড়তে শুরু করে। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।

কর-জিডিপির হার কম থাকার পেছনে অনিয়ম-দুর্নীতিকে বড় করে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটি কয়েক মাস আগে নিবিড় গবেষণা করে মন্ত্রিপরিষদকে বিভাগকে এক চিঠিতে জানিয়েছে, অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করতে পারলে বছরে অন্তত ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহ করা সম্ভব, যা জিডিপির ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে। বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও বলেছেন, কর রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব তখনই, যখন কর রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সব ধরনের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও অপচয় রোধ করা যাবে।

অর্থমন্ত্রী ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার যে বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তাতে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর এবং শুল্ক—এই তিন শ্রেণিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একার দায়িত্ব হচ্ছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা। এর বাইরে বিভিন্ন ফি, টোল, ইজারা, সুদ, জরিমানা ইত্যাদি থেকে ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা এবং জমির খাজনা, স্ট্যাম্প বিক্রি ইত্যাদি থেকে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে হবে। আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপির আকার ধরা হয়েছে ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা।

 বিশ্বব্যাংকের হিসাবে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে ২০১৫ সালেই। আর জাতিসংঘের হিসাবে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের সিঁড়িতে পা দেবে ২০২৪ সালে। উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার ঠিক পাঁচ বছর আগের এই সময়ে জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আহরণের চিত্রে হতাশ সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানও।

সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কর-জিডিপি পরিস্থিতিকে শুধু লজ্জাজনক না, আমি উদ্বেগজনক বলব। কারণ, উন্নয়নশীল দেশের যে কাতারে আমরা উঠতে যাচ্ছি এবং এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ইত্যাদি খাতে যে পরিমাণ বাড়তি বরাদ্দ দরকার, সংকটের কারণেই সেই পরিমাণ অর্থ সরকার বরাদ্দ দিতে পারছে না।’

সেলিম রায়হান আরও বলেন, আয়কর দেওয়ার যোগ্য অনেক লোক থাকলেও সরকার তাঁদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না বা পৌঁছাতে চাচ্ছে না। এর এক নম্বর কারণ, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব।