নতুন ভ্যাট আইনে অনেক চ্যালেঞ্জ

প্রায় ২৮ বছর পর নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। আজ সোমবার অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হচ্ছে দেশে। ২০১২ সালে নতুন আইনটি প্রণয়ন করা হলেও ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে তা সাত বছর পর কার্যকর হচ্ছে। আর ব্যবসায়ীদের চাপে নানামুখী ছাড় দিয়ে মূল আইনে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, নতুন আইনটি বাস্তবায়ন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং ও হয়রানিমূলক হবে। এ আইনে ভ্যাট কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ বেশি।

নতুন ভ্যাট আইনটি মাঠপর্যায়ে কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা আছে। প্যাকেজ ভ্যাট প্রথা উঠে যাওয়ার ফলে কিসের ভিত্তিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভ্যাট মওকুফের সীমা নির্ধারণ করা হবে, তা স্পষ্ট নয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে হিসাবপত্র রাখার বিষয়টিও শুধু কাগজ-কলমে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

সার্বিকভাবে নতুন ভ্যাট আইনটি বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই। নতুন আইনে সবকিছু অনলাইনে হওয়ার কথা থাকলেও এখনোই তা পুরোপুরি শুরু করা যাচ্ছে না।

মূল আইনের একক ১৫ শতাংশ হারের পরিবর্তে আটটি ভ্যাট হার করা হয়েছে। নতুন ভ্যাট হারগুলো হলো ২, ২.৪, ৩, ৪.৫, ৫, ৭.৫, ১০ ও ১৫ শতাংশ।

নতুন আইনটি সম্পর্কে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সোজা কথায় বলেন, নতুন বোতলে পুরোনো মদ। সবকিছুই পুরোনো আইনের মতো। তাঁর মতে, নতুন আইনটি বাস্তবায়ন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হবে। ব্যবসায়ীদের আগের চেয়ে বেশি হয়রানি হতে হবে। যেমন ২০১২ সালের মূল আইনে নিবন্ধন, ভ্যাট পরিশোধসহ অনলাইন ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল। অথচ এখন ভ্যাট নিবন্ধনের ক্ষমতা কমিশনারের কাছে দেওয়া হয়েছে। ভ্যাট কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে গিয়ে নিবন্ধন দেবেন।

নানা জটিলতা

নতুন আইনে প্যাকেজ ভ্যাট ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকার কম হলে ভ্যাট দিতে হবে না। অথচ কোনো প্রতিষ্ঠানের লেনদেন ৫০ লাখ টাকার কম, সেটি নির্ধারণের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। এটি জানতে ভ্যাট কর্মকর্তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে তদারকি করতে হবে। কিছুদিন পর্যবেক্ষণের পর ভ্যাট কর্মকর্তাদের ঠিক করতে হবে, ওই প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাটের আওতায় কি না। তা না হলে ছোট–বড় সব ব্যবসায়ীর সততার সঙ্গে নিখুঁতভাবে লেনদেনের হিসাব রাখতে হবে।

>

২৮ বছর পর নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে
এই আইনে যেমন অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, তেমনি অনেক বিষয় স্পষ্ট নয়

পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা প্রথম আলোকে বলেন, ৫০ লাখ টাকার কম লেনদেন নির্ধারণ করবে কে? ভ্যাট কর্মকর্তারা নির্ধারণ করলে তাঁদের ‘মজা’ আরও বাড়বে। এই বিষয়টি পরিষ্কার করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, লেনদেনের হিসাব রাখতে মেশিন বসালে লোকবল ও টাকা লাগবে। এতে পণ্যের দাম বাড়বে।

আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাট (এটিভি) উঠিয়ে ৫ শতাংশ ভ্যাটের আগাম কর বসানো হয়েছে, যা সমন্বয় করা যাবে। কিন্তু কোন খাত থেকে এনবিআর রেয়াতের টাকা দেবে, তা স্পষ্ট নয়। বড় আমদানিকারকদের একেকটি চালানে আমদানি পর্যায়ে কয়েক কোটি টাকা আগাম কর দিতে হবে। তাঁরা ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন। ভ্যাট রিটার্ন দিয়ে রেয়াতের টাকা ফেরত পেতেও কয়েক মাস সময় লেগে যাবে। এই সময়ে ব্যাংক সুদের টাকা গুনতে হবে। অনেকে মনে করেন, সরকারি কোষাগার থেকে রেয়াতের টাকা ফেরতের আশার পরিবর্তে ব্যবসায়ীরা ভ্যাটের টাকা ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দিলে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে।

ইতিহাস

১৯৮৬ সালে বিশ্বব্যাংকের কর সংস্কার মিশনের সুপারিশে প্রথম ভ্যাট ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে ভ্যাট আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। ১৯৯১ সালের ১০ জুলাই থেকে সীমিত পরিসরে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে ওই আইনের বিচ্যুতি হয়। দীর্ঘ ২১ বছর পর ২০১২ সালে নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে বাস্তবায়নের কথা থাকলেও ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে তা দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়।