'রাজহাঁসের ব্যথা' কি কমবে

নতুন অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বেশ বড় একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমনিতে বাজেট বক্তৃতায় স্বপ্ন আর প্রতিশ্রুতির অভাব থাকে না। শেষ পর্যন্ত অনেক স্বপ্নই পূরণ হয় না, প্রতিশ্রুতিরও বাস্তবায়ন হয় না। সাধারণ মানুষ ভুলেও যায়। তবে এবার স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতির কথা অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্ভবত বিশেষভাবে বলতে চেয়েছেন। পুরো বাজেট বক্তৃতায় বিশেষ বিশেষ অংশ তিনি ‘বোল্ড’ করে রেখেছেন, যাতে সহজে নজরে আসে। যেমন ১২ পৃষ্ঠায় ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘এখানে দেশবাসীকে অবহিত করাটা প্রয়োজন মনে করছি যে, আমরা ২০১৯-২০-এর বাজেটটিতে দেশের জনগণের নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে, তেমন কোনো উপকরণ অন্তর্ভুক্ত করিনি।’

অর্থমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতিপূর্ণ নতুন বাজেট ১ জুলাই (গত সোমবার) বাস্তবায়ন শুরু হয়ে গেছে। এই দিন আবার নতুন অর্থবছরেরও প্রথম দিন। আর নতুন অর্থবছর শুরুই হলো নিজের পকেট থেকে ১৭৫ টাকা বাড়তি খরচের বোঝা নিয়ে। এটা কেবল রান্নাঘরের গ্যাসের চুলায় প্রতি মাসে বাড়তি খরচ। এতেই পার পাওয়া যাবে না। কারণ, বেড়েছে সব ধরনের গ্যাসের দাম, গড়ে ৩২ দশমিক ৮০ শতাংশ। সুতরাং এর প্রভাব পড়বে জীবনযাপনের সব ক্ষেত্রে। গ্যাসভিত্তিক শিল্পকারখানায় বাড়বে উৎপাদন খরচ, বাড়বে পণ্যমূল্য। প্রভাব পড়বে পরিবহনেও। চাপে পড়বেন সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা।

একটি সরকারের জাতীয় বাজেট ও একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বাজেটের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। সরকার আগে ব্যয়ের খাত ঠিক করে, এরপর আয়ের উৎস দেখে। ঘাটতি পূরণে সরকার ধার নিতে পারে এবং সেই ধার পরের অর্থবছরগুলোতে চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু একজন ব্যক্তির বাজেট ঠিক উল্টো। আগে আয়, সেই অনুযায়ী ব্যয়ের চিন্তা। সামর্থ্যের বাইরে ধার করার সুযোগ ব্যক্তির নেই। সুতরাং যেকোনো ধরনের বাড়তি ব্যয় সাধারণ নাগরিকদের ব্যক্তিগত বাজেটকেই এলোমেলো করে দেয়। নতুন অর্থবছর আরও অনেক ক্ষেত্রেই বাজেট এলোমেলো করে দেবে।

এখন অর্থমন্ত্রী বলতে পারেন, গ্যাসের দাম তো বাজেটে বাড়ানো হয়নি, তাই এটি তাঁর এখতিয়ারের বাইরে। আসলে এবারের বাজেটের অনেক প্রস্তাবই চাপে ফেলবে অসংখ্য মানুষকে। এর অনেক চাপ আর্থিক, বেশ কিছু চাপ অবশ্যই মানসিক। সৎ ও নিয়মিত করদাতাদের কোনো রকম ছাড় না দিয়ে কালোটাকার মালিকদের বিশেষ সুযোগ দেওয়াটা এ রকমই এক চাপ।

ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা পাঁচ বছর ধরে বাড়েনি, বাংলাদেশে সম্ভবত এটি একটা নতুন রেকর্ড। যদিও এ সময়ে প্রায় ৩১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর মানে হলো, আগের চেয়ে কম প্রকৃত আয় করেও মানুষ করের আওতায় চলে আসছেন। আবার চাকরিজীবীরা কর এড়িয়ে যাবেন, সে সুযোগ নেই। কেননা, কর বিবরণী বা রিটার্ন না দিলে প্রতিষ্ঠান বেতন দিতে পারবে না। সুতরাং এখানে স্বস্তি নেই। আবার ব্যক্তি করদাতারা কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপ কিনে বিনিয়োগ দেখিয়ে কিছুটা কর ছাড় পেতেন। সেটা তুলে নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

কিন্তু ধনীদের সম্পদে সারচার্জে ঠিকই ছাড় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ বছর থেকে তিন কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে তবে সারচার্জ দিতে হবে, যা আগে ছিল দুই কোটি টাকা। সাদাচোখে অবশ্য অতিধনীদের কাছ থেকে কিছু টাকা আদায়ের চেষ্টা হয়েছে। যেমন ৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে তার সম্পদ মূল্যের দশমিক ১ শতাংশ অথবা আয়ের ৩০ শতাংশ, যেটা বেশি সেটা সারচার্জ হিসেবে দিতে হবে। আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশে সম্পদ বাজারমূল্যে না দেখিয়ে ক্রয়মূল্যে দেখানো হয়। এ ছাড়া ধনীদের গাড়িসহ অন্যান্য সম্পদ কোম্পানির নামে দেখানোর প্রবণতা রয়েছে। ফলে এই খাতে কর আদায় হয় সামান্যই।

>

বাজেট বাস্তবায়ন প্রতি অর্থবছরের চ্যালেঞ্জ
ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা পাঁচ বছর ধরে বাড়েনি, দেশে এটি নতুন রেকর্ড
ধনীদের সম্পদে সারচার্জে ঠিকই ছাড় দেওয়া হয়েছে বাজেটে
পরোক্ষ কর সব শ্রেণির মানুষের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে

বাজেটে এবার প্রত্যক্ষ করে সাধারণ করদাতাদের কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি, কিন্তু চাপানো হয়েছে পরোক্ষ করের বোঝা। এবারের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। এটি সবচেয়ে বড় পরোক্ষ কর, যা সরাসরি দেবেন ব্যবসায়ীরা, কিন্তু টাকাটা যাবে মূলত সাধারণ ভোক্তাদের পকেট থেকেই। সারা পৃথিবীতে যেখানে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে জোর দেওয়া হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশে পরোক্ষ করের মাধ্যমে সব শ্রেণির মানুষের ওপর চাপ তৈরি করা হচ্ছে। এমনিতে কর-জিডিপি অনুপাতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় সর্বনিম্নে। যাঁরা এই অনুপাত বাড়িয়েছেন, তাঁরা মূলত ভর করেছেন প্রত্যক্ষ করের ওপর। অথচ আমরা বাড়িয়ে চলেছি পরোক্ষ কর।

যদিও অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় মোটা হরফে বলেছেন, ‘আমাদের সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হলো, আমরা কোনোভাবেই কোনো করদাতার ওপর বোঝা হিসেবে কর চাপিয়ে দেওয়ার বিপক্ষে।’ এরপর অর্থমন্ত্রী ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের অর্থমন্ত্রীর একটি উক্তির কথা বলেছেন। তাঁর মতে, কর আদায়ে এটাই অনেকটা তাঁর সরকারের নীতি। আর উক্তিটি হলো, ‘রাজহাঁস থেকে পালক ওঠাও যতটা সম্ভব ততটা, তবে সাবধান, রাজহাঁসটি যেন কোনোভাবেই ব্যথা না পায়।’

আমরা সবাই জানি, পরোক্ষ কর আদায়ে ব্যথা পাওয়া যাবেই। আর প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে সমস্যা হলো সেই সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁসটির মতো। বারবার ডিম দেয় বলেই তার ওপরই যত ভরসা, যত নির্যাতন। দেখা যায় বাংলাদেশে যাঁরা নিয়মিত আয়কর দেন, চেষ্টা থাকে তাঁদের কাছ থেকেই যত বেশি আদায় করা যায়। আর যাঁরা দেন না বা ফাঁকি দেন, তাঁরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সুখের কথা, অর্থমন্ত্রী নিজেও তা স্বীকার করেছেন। বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমাদের দেশে একবার যাঁরা কর প্রদান করেন, তাঁরাই প্রতিবছর সরকারকে কর প্রদান করে থাকেন। অন্যরা কর প্রদানে শক্তিশালী অবস্থানে থাকলেও তাঁরা কর প্রদান করেন না। এই অপসংস্কৃতি থেকেও আমরা বেরিয়ে আসতে চাই।’ অর্থমন্ত্রী এই প্রতিশ্রুতি রাখবেন আশা করি।

একটা সাধারণ কিন্তু বহু চর্চিত কথা হচ্ছে বাজেট বাস্তবায়নই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। আসলে এ নিয়ে কথা কম বলাই ভালো। কেননা, এই চ্যালেঞ্জ সরকার নেবে বলে মনে হয় না। বরং গতানুগতিক পথেই হবে বাজেট বাস্তবায়ন। যেমন অর্থবছরের শুরুতে বড় বাজেট পেশ, কিন্তু অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আয় হবে না, কমাতে হবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার। ফলে বাস্তবায়িত হবে না মূল বাজেট, করতে হবে সংশোধন। বছরের পর বছর এটি চলে আসছে। একই কাঠামোতে এবারের বাজেটটিও দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এই বাজেটের ভাগ্যও হবে একই রকম। নাকি নতুন অর্থমন্ত্রী সত্যিকার অর্থে বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জটি নেবেন, সেটাই এখন প্রশ্ন।