রসমঞ্জরি, মরিচ ও ভুট্টায় গাইবান্ধা জেলার ব্র্যান্ডিং

গাইবান্ধার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার চরাঞ্চলে ব্যাপক হারে ভুট্টার চাষ। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ে ভূট্টাকেও সামনে আনা হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো
গাইবান্ধার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার চরাঞ্চলে ব্যাপক হারে ভুট্টার চাষ। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ে ভূট্টাকেও সামনে আনা হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো

গাইবান্ধা জেলাকে পরিচিত করতে তিনটি পণ্যকে দিয়ে ব্র্যান্ডিং করছে জেলা প্রশাসন। লক্ষ্য, এই তিন পণ্যের নাম শুনলে যাতে যে কেউ গাইবান্ধাকে চিনতে পারে, গাইবান্ধা পরিচিতি পায়। পণ্য তিনটি হচ্ছে রসমঞ্জরি, মরিচ ও ভুট্টা। তিনটি পণ্যকে নিয়ে স্লোগান তৈরি করা হয়েছে। তা হচ্ছে স্বাদে ভরা রসমঞ্জরির ঘ্রাণ, চরাঞ্চলের ভুট্টা-মরিচ গাইবান্ধার প্রাণ।

ব্র্যান্ডিংয়ের অনুমতি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও প্রকল্প পরিচালককে কর্মপরিকল্পনা পাঠানো হয়েছে। সাবেক জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট এই কর্মপরিকল্পনা পাঠান। ওই আবেদনে উল্লেখ করা হয়, রসমঞ্জরি গাইবান্ধা জেলার তথা উত্তরবঙ্গের একটি অন্যতম মিষ্টান্ন পণ্য। আর চরাঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ভুট্টা ও মরিচের চাষ হচ্ছে। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের নিদর্শন হিসেবে পণ্য তিনটি ক্রমান্বয়ে সমগ্র দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক পণ্যের সঙ্গে এই পণ্যকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রেখে বাজার সৃষ্টি, বিদেশে রপ্তানির লক্ষ্যে সারা দেশে ব্যাপক প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ইতিমধ্যে গৃহীত কার্যক্রম সম্প্রসারণ, পণ্যের আধুনিকায়ন, দেশের ভেতরে এবং দেশের বাইরে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ অনুযায়ী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে এই তিন পণ্যের ব্যবহার ফুটিয়ে তোলার দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক মো. আবদুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাইবান্ধার রসমঞ্জরি, ভুট্টা ও মরিচকে জেলা ব্র্যান্ডিং করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প পরিচালক বরাবর আবেদন পাঠানো হয়েছে। এই তিন পণ্যকে আমরা জেলার ব্র্যান্ডিং বলছি।’

গাইবান্ধার রসমঞ্জরি: গাইবান্ধা জেলার ঐতিহ্যবাহী ও সুস্বাদু এক মিষ্টির নাম রসমঞ্জরি। ব্যবসায়িকভাবে ১৯৪০ সালে এই মিষ্টির উৎপাদন শুরু হয়। তবে এর সুনাম ও পরিচিতি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ১৯৫০ সালের দিকে। রসমঞ্জরির উদ্ভাবন করেছিলেন গাইবান্ধা শহরের মিষ্টি ভান্ডারের মালিক রাম মোহন দে। প্রতি কেজি রসমঞ্জরি তৈরি করতে শ্রমিকসহ উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ২৬০ টাকা। বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি রসমঞ্জরি ২৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। দোকানে প্রতি প্লেট ৫০ টাকা।

গাইবান্ধায় তৈরি হলেও এই বিশেষ মিষ্টির সুনাম দেশব্যাপী ছড়িয়ে আছে। সাংসদ-মন্ত্রীসহ দেশের যেকোনো এলাকা থেকে কেউ গাইবান্ধায় এলেই প্রথমে রসমঞ্জরির স্বাদ নিতে চান। যেকোনো আনন্দ অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে অফিস-আদালতে ফাইলমুক্তির কাজও সম্পন্ন করা সম্ভব হয় রসমঞ্জরির বিনিময়ে। গাইবান্ধা যুব নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক জিয়াউল হক বলেন, একসময় রসমঞ্জরি সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এখন এটি অর্থনৈতিক পণ্য। এই সুনাম ধরে রাখতে উৎপাদনকারীদের সচেষ্ট থাকতে হবে।

গাইবান্ধা জেলা ব্র্যান্ডিংয়ে মরিচও একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। ছবি: প্রথম আলো
গাইবান্ধা জেলা ব্র্যান্ডিংয়ে মরিচও একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। ছবি: প্রথম আলো

কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক কেজি রসমঞ্জরি তৈরি করতে আড়াই কেজি দুধ, ১০০ গ্রাম চিনি, ২৫ গ্রাম ময়দা, ২০০ গ্রাম দুধের ছানা, এলাচসহ পাঁচ টাকার মসলার প্রয়োজন। প্রথমে ছানার সঙ্গে ময়দা মিশিয়ে গুটি গুটি রসগোল্লা তৈরি করতে হয়। ছোট ছোট মার্বেল আকৃতির এই মিষ্টি দুধের ক্ষীরের সঙ্গে গরম করে মেশাতে হয়। এরপর দুধ ঘন করে জ্বাল দিয়ে সেই ঘন দুধের সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু রসমঞ্জরি। এসব সামগ্রী দিয়ে তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সহজেই এই মিষ্টি তৈরি হয়। জেলার অন্যতম মিষ্টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গাইবান্ধা মিষ্টান্ন ভান্ডারের ব্যবস্থাপক এস এম রাশেদ আহমেদ বলেন, ‘গাইবান্ধার ঐতিহ্যবাহী রসমঞ্জরি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রসমঞ্জরি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গ্রাহকেরা এই মিষ্টি নিয়ে যাচ্ছেন, আমরা কেবল পাঠানোর জন্য প্রক্রিয়াজাত করে দিচ্ছি।’

চরাঞ্চলের মরিচ: গাইবান্ধার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার চরাঞ্চলে মরিচের বাম্পার ফলন হয়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার সাতটি উপজেলায় এ বছর এক হাজার ৭২৫ হেক্টর জমিতে মরিচের চাষ হয়েছে। মরিচ উৎপাদন হয়েছে দুই হাজার ৮১৩ মেট্রিক টন। এর মধ্যে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলে বেশির ভাগ মরিচ উৎপাদিত হয়।
গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দুরে ফুলছড়ি পুরোনো উপজেলা হেডকোয়ার্টার মাঠে মরিচের হাট বসে। ২০০৪ সাল থেকে প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার এখানে হাট বসে। কৃষকেরা জানান, দেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠান প্রাণ, এসিআই কোম্পানির প্রতিনিধি এবং ঢাকা, বগুড়া, সান্তাহারসহ বিভিন্ন এলাকার পাইকারেরা এখান থেকে মরিচ কেনেন। প্রতি হাটে শতাধিক কৃষক ২০০ থেকে ৩০০ মণ মরিচ বিক্রি করে থাকেন। চরাঞ্চলের অনেক কৃষক মরিচ বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
ফুলছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ী এবং বড় বড় কোম্পানির লোকজনও এখানকার উৎপাদিত লাল মরিচ কিনতে ফুলছড়িতে আসেন। বর্তমান ফুলছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান জি এম সেলিম পারভেজ বলেন, মরিচ চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

গাইবান্ধা জেলার ঐতিহ্যবাহী ও সুস্বাদু এক মিষ্টির নাম রসমঞ্জরি। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ে এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে জেলা প্রশাসন। ছবি: প্রথম আলো
গাইবান্ধা জেলার ঐতিহ্যবাহী ও সুস্বাদু এক মিষ্টির নাম রসমঞ্জরি। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ে এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে জেলা প্রশাসন। ছবি: প্রথম আলো

চরের জমিতে ভুট্টা: মরিচের মতো গাইবান্ধার ফুলছড়ি, সাঘাটা, সুন্দরগঞ্জ ও সদর উপজেলার চরাঞ্চলে ব্যাপক হারে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার সাতটি উপজেলায় এ বছর ১৩ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু চাষ হয়েছে ১৩ হাজার ৪৪৫ হেক্টরে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩২ মেট্রিক টন।

সূত্র জানায়, নদীতীরবর্তী চরাঞ্চলে ভুট্টার চাষ হচ্ছে বেশি। এক হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষে উৎপাদন খরচ হয় প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। প্রতি মণ ভুট্টা ৬৫০-৭০০ টাকা। নভেম্বর মাসে ভুট্টা চাষ করা হয়। কাটা যায় ফেব্রুয়ারি মাসে। কৃষকেরা জানান, গত বছরের মাঝামাঝি দুই দফা বন্যার কারণে আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। অর্থ ও চারার অভাবে অনেক কৃষক আমন রোপণ করতে পারেননি। তাই আমনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবার কৃষকেরা ভুট্টা চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন।

সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের কুন্দেরপাড়া গ্রামের কৃষক ভোলা মিয়া (৫৫) বলেন, ‘ভুট্টের আবাদ করতে বেশি ট্যাকা নাগে না। কম খরচে ভালো নাব করা যায়। তাই দুই বিগেত ভুট্টে করচি। ফলোন ভালো হচে, হামরা খুশি।’
কামারজানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম বলেন, চরের কৃষকেরা এখন বেশি জমিতে ভুট্টা চাষ করেন। তাঁরা এখন সচ্ছল। মোল্লারচর ইউনিয়নের বাজে চিথুলিয়া গ্রামের কৃষক সাইদুর রহমান (৫৬) বলেন, আবহাওয়া ভালো থাকায় এ মৌসুমে ভুট্টার ভালো ফলন হয়েছে। প্রতি হেক্টর জমিতে ২৬০ মণ ভুট্টা উৎপাদিত হয়। ভুট্টা চাষে অল্প সময় ও খরচে বেশি লাভবান হওয়া যায়। একই গ্রামের কৃষক আশরাফুল মিয়া (৬০) বলেন, ‘এবার আমি পাঁচ বিঘা জমিতে ভুট্টা এবং এক বিঘায় গম চাষ করেছি। ফলন ভালো হয়েছে। চরে বসবাস করলেও আমাদের কোনো অভাব নেই।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এস এম ফেরদৌস বলেন, গাইবান্ধার চারটি উপজেলার চরাঞ্চলে একসময় কোনো ফসল হয়নি। এখন সেই সব জমিতে ভুট্টার বাম্পার ফলন হচ্ছে। ভুট্টা চাষেও কৃষি প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।