ব্যাংক ও প্রকল্পের জটিলতা কাটছেই না

‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের নাম এখন ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প। কিন্তু পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ও এ প্রকল্পের কর্মচারীদের জটিলতা আর কাটছেই না। নিয়োগ, পদোন্নতি নিয়ে নতুন করে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ চলছে। আট দফা দাবিতে ১০ দিন ধরে চলছে কর্মচারীদের আন্দোলন, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও কর্মবিরতি।

তবে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কর্মচারীদের এ আন্দোলন অযৌক্তিক বলে আখ্যায়িত করেছেন প্রকল্পটির পরিচালক এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আকবর হোসেন।

অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে (এলজিআরডি) গত ৮ জুলাই চিঠি পাঠিয়ে আকবর হোসেন বলেছেন, আন্দোলনের কারণে প্রকল্প এবং ব্যাংকের কর্মচারীদের সার্বিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। বিঘ্ন ঘটছে মাঠপর্যায়ের কাজেও। ফলে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে এখনই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগের এ প্রকল্প এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কাজ বাস্তবায়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি এলজিআরডি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির নতুন নাম ঘোষণা করেন ‘আমার বাড়ি আমার খামার’। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬ সালের শাসনামলে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দেয়।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আবার চালু করে এ প্রকল্প। এরপর ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্যাংকটি মূলত ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পেরই পরবর্তী রূপ। ব্যাংকের পাশাপাশি ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদও বাড়ানো হয়।

বর্তমানে প্রকল্পের উপকারভোগী সদস্য পরিবার ৪৫ লাখ ৩৭ হাজার এবং সমিতি ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৬টি। এতে ১ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা সদস্যদের সঞ্চয় রয়েছে। আর সরকারের দেওয়া বোনাসের পরিমাণ ১ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। প্রকল্পের ঘূর্ণমান তহবিল ২ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা।

আন্দোলন নিয়ে এমডির প্রশ্ন

পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এমডি চিঠিতে বলেছেন, প্রকল্পের কর্মচারীরা (পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে স্থানান্তরিতরাসহ) দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরি স্থায়ীকরণ, পদোন্নতি এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে সরাসরি নিয়োগ বন্ধের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাব ও ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন। প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন তাঁরা। সারা দেশে কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন এবং যেসব কর্মচারী কর্মস্থলে আছেন, তাঁদের ওপর নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন।

কতিপয় উপজেলা সমন্বয়কারী, যাঁরা ব্যাংকে অফিসার (সাধারণ) হিসেবে স্থানান্তরিত, তাঁরাই পুরো আন্দোলন প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং ২০১৬ সালের ৩০ জুনের আগে প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ কর্মচারী বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

চিঠিতে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এমডি আরও জানান, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক আইন, ২০১৪-এর বিধান অনুযায়ী প্রকল্প ও ব্যাংকের মধ্যে হওয়া সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩০ জুন তারিখে প্রকল্পে কর্মরত কর্মচারীরা ব্যাংকে স্থানান্তরিত হবেন। সে অনুযায়ী প্রকল্পের উপজেলা পর্যায়ের ৫ হাজার ৩৬৮ জন কর্মচারীর মধ্যে ৪ হাজার ৭৫৬ জনকে ২০১৮ সালের ১ আগস্ট তারিখ থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে। গত ১ জুলাই তাঁদের জন্য একটি করে ইনক্রিমেন্টও (বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি) মঞ্জুর করা হয়েছে। তবু কেন এই আন্দোলন? এর পেছনে কোনো মহলের চক্রান্ত কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।

ব্যাংকের এমডি আকবর হোসেন এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারকে জানানো হয়েছে।

আটকে আছে পদোন্নতি নীতিমালা
কর্মচারীদের পদোন্নতি নীতিমালার একটি খসড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে জানিয়ে চিঠিতে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এমডি জানান, নীতিমালাটি অনুমোদিত হলেই পদোন্নতির কার্যক্রম শুরু হবে। এটি জেনেও তাঁরা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। ৬৪টি জেলা শাখা এবং ৪৮৫টি উপজেলাসংবলিত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদ ৫৫০টি। এর ৫০ শতাংশ সরাসরি নিয়োগ এবং বাকি ৫০ শতাংশ প্রকল্প থেকে স্থানান্তরিত কর্মচারীদের মধ্য থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণযোগ্য।

এমডির চিঠিতে বলা হয়েছে, সরাসরি নিয়োগযোগ্য পদে জনবল বাছাইয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকারস সিলেকশন কমিটিকে অনুরোধ করা হলে ওই কমিটি ২৭৮ প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক এর মধ্যে ২৪৮ জনকে নিয়োগপত্র দেয়।

কিন্তু প্রকল্পের ১২৯ জন উপজেলা সমন্বয়কারী (যাঁদের মধ্যে তিনজন বাদে সবাই এখন অফিসার) হাইকোর্টে দুটি রিট মামলা করলে হাইকোর্ট ১২৯টি সরাসরি নিয়োগযোগ্য পদ সংরক্ষণে রুল জারি করেন। সে অনুযায়ী ব্যাংক ১২৯টি পদ বাদ দিয়ে ১৪৯ প্রার্থীর যোগদানপত্র গ্রহণ করে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা নতুন সিনিয়র অফিসারদের পদায়ন বন্ধ করার দাবি তুলছেন। এ দাবি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, ব্যাংকের পদোন্নতি নীতিমালা চূড়ান্ত করতে চলতি মাসেই বৈঠক হবে।

আন্দোলনকারীদের আট দফা দাবি

‘আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক কর্মকর্তা কর্মচারী সমিতি’ নামে একটি ব্যানারে আট দফা দাবি জানানো হচ্ছে। সর্বশেষ গত ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সোলায়মান স্বাক্ষরিত স্মারকলিপিতে এ দাবির কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

দাবিগুলো হচ্ছে ৩০ জুন ২০১৬-এর আগে নিয়োগকৃত প্রকল্পের সব জনবলকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে স্থায়ী নিয়োগ দিয়ে পরিপত্র জারি করতে হবে। আর ৩০ জুন ২০১৬-এর আগে প্রকল্পে নিয়োগ পাওয়া উপজেলা সমন্বয়কারীদের জ্যেষ্ঠতাসহ ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার পদে আগে নিয়োগ দিতে হবে, তারপর ব্যাংক চাইলে নতুন সিনিয়র অফিসারদের নিয়োগ দিতে পারে।

এ ছাড়া ফিল্ড সুপারভাইজার, কম্পিউটার অপারেটর কাম হিসাব সহকারী ও মাঠ সহকারীদের মধ্য থেকে উচ্চতর পদের সব শূন্য পদে পদোন্নতিসহ মাঠ সহকারীদের পদবি পরিবর্তন করে সহকারী জুনিয়র অফিসার (মাঠ) করা; পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ; আর্থিক লেনদেনে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা আনা; প্রকল্পে নিয়োগের দিন থেকে চাকরিকাল গণনা করা; স্থানান্তর নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে ২০১৬ সালের পর নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের ব্যাংকে স্থানান্তর করা এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের হয়রানি না করা।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্পে দীর্ঘ আট বছর ধরে এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে তিন বছর ধরে কর্মরত কর্মচারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে না বলে আশা করছি।’