পতন ঠেকানোর চেষ্টা ব্যর্থ

শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য ঘোষিত প্রণোদনারও ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি বাজারে। বরং উল্টো টানা দরপতন ঘটেছে গত ৩০ জুন বাজেট পাসের পর থেকে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের শেয়ারবাজারে গতকাল সোমবার আবারও বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে। 

বড় দরপতনের কারণে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স প্রায় আড়াই বছর আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ৩০ জুনের পর শেয়ারবাজারে ১০ কার্যদিবস লেনদেন হয়। এর মধ্যে ৯ দিনই বাজারের সূচক কমেছে। বেড়েছে কেবল ১ দিন। তার মধ্যে গতকাল ১ দিনেই ডিএসইএক্স সূচকটি ৮৮ পয়েন্ট বা পৌনে ২ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৫ হাজার ৯১ পয়েন্টে। এর আগে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি ডিএসইএক্স সূচকটি ৫ হাজার ৮৪ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল।

 টিকলু কান্তি দাশ শেয়ারবাজারের একজন বিনিয়োগকারী। প্রথম আলোকে জানালেন, ভালো মৌলভিত্তির দুই কোম্পানির শেয়ার বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। গত তিন মাসে এসব শেয়ারের দাম ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। বড় লোকসানে পড়ায় লেনদেনে অংশ নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়েছেন। 

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাম্প্রতিক এ দরপতনের পেছনে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য মিলিয়ে একগুচ্ছ কারণ রয়েছে। বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যেসব কারণ উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে দৃশ্যমান কারণগুলো হলো বিনিয়োগকারীর আস্থার সংকট, ব্যাংক খাত তথা আর্থিক খাতের তারল্যসংকট, সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার পাওনা আদায়ে বিটিআরসির পক্ষ থেকে গ্রামীণফোনের ব্র্যান্ডউইডথের সক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া, মানহীন কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি, পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের সিদ্ধান্তের প্রভাব। আর অদৃশ্য কিন্তু বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে এমন কারণের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ইস্যুতে নীতির প্রশ্নে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বড় একটি অংশের পরস্পরবিরোধী অবস্থান, প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রির নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বা লক–ইন নিয়ে মার্চেন্ট ব্যাংকার ও ব্রোকারদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান, তালিকাভুক্ত কোম্পানির মুনাফা ও লভ্যাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা ইত্যাদি। 

 বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী সামগ্রিক বিষয়ে বলেন, বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেখানে প্রণোদনার কিছু নেই। বাজেটে করমুক্ত লভ্যাংশ আয়ের সীমা বাড়ানো হয়েছে। এ সুবিধা পাবেন যাঁরা কর দেন কেবল তাঁরাই। শেয়ারবাজারের বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই কর দেন না। তাই তাঁদের জন্য এ সুবিধা কোনো কাজে আসবে না। এ ছাড়া বোনাস লভ্যাংশ ও রিটেইনড আর্নিংস নির্ধারিত সীমার বেশি হলে বাড়তি করারোপের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির লভ্যাংশ প্রদানের সক্ষমতা কমে যেতে পারে। কারণ অনেক কোম্পানির নগদ প্রবাহ কম থাকে, তখন তারা বোনাস লভ্যাংশ দেয়। এখন বাড়তি করের ভয়ে বোনাস লভ্যাংশ দেওয়াও তাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আবার আমাদের বিনিয়োগকারীরা বোনাস লভ্যাংশ অপছন্দ করে এমন নজিরও কম। এ কারণে বাজেটে যেসব ব্যবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে তা বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

গ্রামীণফোনের দাম কমেছে ৯৩ টাকা

গত ১ এপ্রিল গ্রামীণফোনের শেয়ারের বাজারমূল্য ছিল ৪১৭ টাকা। গতকাল দিন শেষে তা নেমে এসেছে ৩২৪ টাকায়। এ সাড়ে তিন মাসে শেয়ারবাজারে লেনদেন হয় ৬৬ দিন। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে দেড় টাকা করে গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম কমেছে। সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার পাওনা আদায়ে কোম্পানিটিকে ২ এপ্রিল প্রথম চিঠি দেয় টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। এরপর ৪ জুলাই পাওনা আদায়ে কোম্পানিটির ব্র্যান্ডউইডথ সক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়। বিটিআরসির নেওয়া এ দুই উদ্যোগের কারণে শেয়ারবাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দামে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। 

পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের প্রভাব

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের এ প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৯ জুলাই এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপর শেয়ারবাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দামের পাশাপাশি আর্থিক খাতের অন্যান্য কোম্পানির দামেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর মধ্যে পিপলস লিজিংসহ আর্থিক খাতের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি হয়ে পড়ার তথ্য সংসদে প্রকাশ করা হয়। খেলাপি হয়ে পড়া অন্য চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স, বিআইএফসি ও প্রাইম ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট। এর মধ্যে প্রথম তিনটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। গতকাল এ তিনটি কোম্পানিরই শেয়ারের দাম নির্ধারিত সীমার সর্বোচ্চ পরিমাণে কমেছে। 

বিএসইসি ও বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরোধ

সম্প্রতি কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের তালিকাভুক্তির ইস্যুতে ডিএসই ও বিএসইসির মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। আর্থিক প্রতিবেদনে বড় ধরনের অসংগতি থাকায় কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্ত না করতে অনড় অবস্থান নেয় ডিএসই। পাশাপাশি আর্থিক প্রতিবেদনের অসংগতির বিষয়গুলো বিএসইসিকে অবহিত করে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা চেয়ে চিঠি দেয় ডিএসই। কিন্তু বিএসইসি সেই চিঠির জবাব না দিয়ে উল্টো প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর টাকা কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে জমার নির্দেশ দেয়। অন্যদিকে কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দিতে নানা পক্ষ থেকে ডিএসইর ওপর চাপ ও নানাভাবে ভয়ভীতিও দেখানো হয়। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ডিএসই কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেয়। তবে এ ক্ষেত্রে বিএসইসির অবস্থান নিয়ে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে ডিএসইর সদস্যদের মধ্যে। 

১১ জুলাই ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমানের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুমোদনের জন্য বিএসইসিতে পাঠায়। কিন্তু বিএসইসি এ বিষয়েও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এ নিয়েও ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদে ক্ষোভ রয়েছে। 

এর বাইরে প্রাক–আইপিও বা প্লেসমেন্ট শেয়ারের বিক্রয় নিষেধাজ্ঞা বা লক–ইনের মেয়াদ নিয়েও ডিএসই, বিএসইসি ও প্লেসমেন্টের সুবিধাভোগী একটি শক্তিশালী পক্ষের মধ্যে রয়েছে তীব্র মতপার্থক্য। আইন পরিবর্তন করে প্লেসমেন্ট শেয়ারের লক–ইনের মেয়াদ তিন বছর করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। কিন্তু বাজারে প্লেসমেন্টের সুবিধাভোগী মার্চেন্ট ব্যাংকারদের একটি পক্ষ তা এক বছর রাখতে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিএসইসি সিদ্ধান্ত না নিয়ে লক–ইনের মেয়াদসহ সংশ্লিষ্ট আইনের বেশ কিছু সংশোধনীর বিষয়ে জনমত সংগ্রহ করেছে। 

বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমান বলেন, ‘বাজারে পতন ঠেকাতে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা সব ধরনের নীতি সহায়তা দিয়েছে। তা সত্ত্বেও এ পতন আমাদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত।’