কৃষিযন্ত্র কেনায় কৃষকদের ব্যাংকঋণ দেওয়া দরকার

সাদিদ জামিল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক,  মেটাল গ্রুপ
সাদিদ জামিল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মেটাল গ্রুপ
>

দেশের কৃষির যান্ত্রিকীকরণের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে। জমি চাষ প্রায় পুরোপুরি যন্ত্রের মাধ্যমে হচ্ছে। এখন বাড়ছে ফসল কাটা ও রোপণে যন্ত্রের চাহিদা। কৃষিযন্ত্রের বাজার নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এ খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি মেটাল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিদ জামিল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাজীব আহমেদ

প্রথম আলো: গত বোরো মৌসুমে ধান কাটার ক্ষেত্রে শ্রমিকসংকট কৃষি খাতের যান্ত্রিকীকরণের প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালোভাবে সামনে এনেছে বলে অনেকে মনে করছেন। আপনাদের কী মত?

সাদিদ জামিল: দেখেন, দেশের কৃষকের গড় বয়স এখন ৪৮ বছর। তরুণেরা কৃষিকাজে যাচ্ছেন না। ধান কাটার মৌসুমে তাই শ্রমিক মিলছে না। বোরোতে আবার ধান খুব দ্রুত কেটে ফেলতে হয়। সব মিলিয়ে এবার ধান কাটা নিয়ে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আমরা বিনা মূল্যে অনেক জায়গায় ধান কেটে দিয়েছি। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, কৃষিতে যদি যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ে, তাহলে কৃষকের উৎপাদন ব্যয়ও কমে। এক একর জমিতে ধান কাটা ও মাড়াইয়ে এখন একজন কৃষকের ১২ হাজার টাকা লাগে। যন্ত্রের ক্ষেত্রে লাগে ৭-৮ হাজার টাকা।

প্রথম আলো: এখন বাংলাদেশের কৃষিযন্ত্রের বাজার কী রকম?

সাদিদ জামিল: জমি তৈরি বা চাষাবাদের ক্ষেত্রে এখন ৯৫ শতাংশ কাজ যন্ত্রের মাধ্যমে হচ্ছে। সে কারণে বছরে ৮-৯ হাজার ট্রাক্টর দেশে আমদানি হচ্ছে। পাওয়ার টিলার আসছে ৫০-৬০ হাজার। সব মিলিয়ে চাষাবাদে আমরা যান্ত্রিকীকরণে এগিয়ে গেছি। এখন ধান কাটা ও মাড়াই এবং রোপণে ব্যবহার বাড়ানোর সময়। ধান কাটায় যান্ত্রিকীকরণের ব্যবহার কিন্তু মাত্র ১ শতাংশ বা তার কম। ধান কাটা ও মাড়াইয়ে আমরা কম্বাইন্ড হারভেস্টরের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এখানে অফুরন্ত সুযোগ আছে। এর পাশাপাশি রোপণযন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

প্রথম আলো: সরকার তো কৃষিযন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে চায়। এ ক্ষেত্রে ভর্তুকিও দেওয়া হচ্ছে।

সাদিদ জামিল: হ্যাঁ। সরকার এ ক্ষেত্রে খুব সহায়তা করছে কৃষকদের। রোপণযন্ত্রে গত অর্থবছরে ৫ লাখ টাকা ও হাওর এলাকায় ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত সরকার ভর্তুকি দিয়েছে। কর্তনযন্ত্রে দামের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি ছিল (মনোনীতদের)। এবার আমরা শুনছি, কম্বাইন্ড হারভেস্টরে ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হতে পারে। এক হিসাব অনুযায়ী, দেশের সব ধান কাটতে ১ লাখ কম্বাইন্ড হারভেস্টর প্রয়োজন। সরকারি হিসাবে আছে মাত্র ২ হাজার। সুতরাং বাজার অনেক বড়।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে অনেক এলাকায় ফসলের মাঠ কর্দমাক্ত থাকে। অনেক এলাকায় ধানের জমি পানিতে ডুবে থাকে। অনেক সময় ধানগাছ বাতাস অথবা ঝড়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে। এসব পরিস্থিতিতে কি যন্ত্রের মাধ্যমে ফসল কাটা সম্ভব?

সাদিদ জামিল: কম্বাইন্ড হারভেস্টর কাদার মধ্যে ধান কাটতে পারে। আবার মাটিতে নুয়ে পড়া ধানগাছও এটা দিয়ে কাটা যায়। দেশের বেশির ভাগ এলাকায় কম্বাইন্ড হারভেস্টর ব্যবহার করে ধান কাটা ও মাড়াই করা যাবে। এর পাশাপাশি আরেকটি সুবিধা হলো, কম্বাইন্ড হারভেস্টরে কাটা ও মাড়াইয়ে ফসল নষ্ট হয় কম। এ ক্ষেত্রে হার ৩ শতাংশ। সনাতন পদ্ধতিতে ৭ শতাংশ পর্যন্ত ফসল নষ্ট হয়।

প্রথম আলো: এসব যন্ত্রের দাম কী রকম? কৃষকের কেনার সক্ষমতার মধ্যে রয়েছে কি?

সাদিদ জামিল: একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টরের দাম ২০ লাখ টাকা। নগদ টাকায় এটা কেনা কঠিন। এ ক্ষেত্রে আমরা চাই, কৃষককে ঋণ দেওয়া হোক। এখন কৃষি খাতে যে ঋণ দেওয়া হচ্ছে, সেখানে কৃষিযন্ত্রে ঋণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করলে কৃষকের জন্য খুবই সুবিধাজনক হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ হবে না। কারণ, ব্যাংকঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে ওই যন্ত্রটাই রাখতে পারবে। আমরা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলেছি, তারা খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তাই এ ক্ষেত্রে দরকার সরকারি উদ্যোগ। কৃষি ঋণের ক্ষেত্রে যেমন ব্যাংকগুলোর লক্ষ্যমাত্রা থাকে, কৃষিযন্ত্রের ক্ষেত্রেও তা করা যেতে পারে।

প্রথম আলো: এখন কারা কৃষিযন্ত্র কিনছে?

সাদিদ জামিল: এ ক্ষেত্রে একটি উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে উঠছে। কিছু কিছু এলাকায় ছোট ছোট কোম্পানি গড়ে উঠছে, যারা এসব যন্ত্র কিনে অর্থের বিনিময়ে চাষাবাদ ও মাড়াই করে দেয়। গ্রামের শিক্ষিত তরুণ ও বিদেশফেরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের বড় উৎস হতে পারে কৃষিযন্ত্রের ব্যবসা।

প্রথম আলো: এসব যন্ত্র কেনা কতটা লাভজনক?

সাদিদ জামিল: একটি যন্ত্র কিনলে কয়েক বছরেই তার টাকা উঠে যায়। কিন্তু যন্ত্রটি ব্যবহার করা যায় ১০ বছরের বেশি সময়। তাই যাঁরা কেনেন, তাঁদের জন্য এটা অনেক লাভজনক।

প্রথম আলো: এবার বাজেটে কৃষিযন্ত্র খাতে কি কোনো পরিবর্তন এসেছে?

সাদিদ জামিল: আমরা দেখছি, কৃষিযন্ত্র আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর আরোপ করা হয়েছে। পরে আয়কর দেওয়ার সময় এটা সমন্বয়যোগ্য। কিন্তু সমস্যা হলো, কৃষিযন্ত্রে মুনাফার হার খুব কম। ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়করের সমপরিমাণ মুনাফা কখনোই হয় না। ফলে এটা ক্রেতার ওপর চাপার আশঙ্কা আছে। ফলে দাম বেড়ে যেতে পারে। এটা কিন্তু সরকারি নীতির বিপরীত। একদিকে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে, অন্যদিকে বাড়তি করারোপের কারণে দাম বাড়ছে।

প্রথম আলো: কৃষক যদি ফসলের ভালো দাম না পান, তাহলে কি যন্ত্র বিক্রির ওপর প্রভাব পড়ে?

সাদিদ জামিল: হ্যাঁ। দাম না পেলে যন্ত্র বিক্রি কমে যায়।

প্রথম আলো: আপনাদের ব্যবসা নিয়ে বলেন, কবে শুরু হলো? এখন কোন কোন খাতে ব্যবসা রয়েছে?

সাদিদ জামিল: আমরা ব্যবসা শুরু করি ১৯৮৭ সালে। ওই বছরের নভেম্বর মাসে আমাদের কোম্পানি যাত্রা শুরু করে। তখন অবশ্য কৃষি যন্ত্রপাতির বাজারে ছিলাম না। আমরা কিছু ট্রাক-বাসের চেসিস আমদানি করে বডি তৈরি করতাম। ১৯৯৩ সালে আমরা কৃষিযন্ত্রের বাজারে প্রবেশ করি। ভারতের টাফে ব্র্যান্ডের ট্রাক্টর আমদানি করে আমাদের কৃষিযন্ত্রের ব্যবসা শুরু হয়। কৃষক পর্যায়ে ট্রাক্টর কিন্তু আমরাই প্রথম এনেছি। এখনো টাফে ট্রাক্টর আমদানি করছি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইশার ব্র্যান্ডের ট্রাক্টর। এ ছাড়া আমাদের বীজ উৎপাদনের ব্যবসা রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন ফসলের বীজ উৎপাদন করা হয়।