কৃষিশ্রমিকের দিনে আয় মাত্র ৩৮৬ টাকা

কৃষিশ্রমিকদের দুর্দিন যেন কাটছেই না। জীবন–জীবিকার চাহিদামতো মজুরি পান না। রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সারা দিন ঘাম ঝরিয়ে এ দেশের একজন কৃষিশ্রমিক গড়ে দৈনিক ৩৮৬ টাকা মজুরি পান। এই টাকা দিয়ে পরিবারের সবার জন্য চাল-ডাল, শাকসবজি কিনতে হয়। আবার জামাকাপড়সহ ছেলেমেয়ের শিক্ষাব্যয়ও মেটাতে হয়। তাঁরা প্রতিদিনই কাজ পান, তা–ও নয়। সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ পান, বাকি দুই দিন বেকার বসে থাকেন।

সম্প্রতি প্রথমবারের মতো কৃষি ও পল্লি পরিসংখ্যান প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সেখানে কৃষিশ্রমিকদের মজুরির দৈন্যদশার এ চিত্র উঠে আসে। সম্প্রতি দেশের সব জেলার পল্লি এলাকার ৫৭ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বিবিএস। এর আগে এ ধরনের জরিপ করা হয়নি, তাই মজুরির তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যায়নি। ১৫ বছরের বেশি বয়সী কৃষিশ্রমিকদের এ প্রতিবেদনের হিসাবে আনা হয়েছে।

বিবিএসের হিসাবে, সপ্তাহে এক দিন মজুরির বিনিময়ে কাজ পেলেই তাঁকে কৃষিশ্রমিক হিসেবে ধরা হয়। বর্তমানে এমন কৃষিশ্রমিক আছেন সাড়ে ৭৭ লাখ। কক্সবাজারে কৃষিশ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি মজুরি দেওয়া হয়। সেখানে দৈনিক ৫০৭ টাকা মজুরি পান একজন কৃষিশ্রমিক। আর সবচেয়ে কম মজুরি মেলে চুয়াডাঙ্গায়, দৈনিক ৩১২ টাকা। বিবিএসের জরিপের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশের গড় মাথাপিছু আয়ের চেয়ে অনেক কম মজুরি পান কৃষিশ্রমিকেরা। বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ১ লাখ ৬০ হাজার ৬০ টাকা। সেই হিসাবে প্রত্যেকের দৈনিক মাথাপিছু আয় হয় ৪৩৮ টাকা।

দেশের মোট আয়কে কর্মক্ষম নারী-পুরুষ, ছাত্রছাত্রী, শিশু, প্রবীণসহ সব নাগরিকের মাথাপিছু ভাগ করে দেওয়া হয়। এই হিসাবে কর্মজীবীদের পাশাপাশি কর্মজীবী নন, এমন মানুষও আছেন। অথচ এ দেশের পৌনে এক কোটি কৃষিশ্রমিক খেতখামারে কাজ করেও এর চেয়ে অনেক কম মজুরি পান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত এক দশকে কৃষিশ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমেছে। গ্রামে কাজের সুযোগ না পেয়ে যেসব অদক্ষ শ্রমিক শহরে আসেন, সেখানেও তাঁরা মজুরি কম পান। এর মানে, কৃষি ও অকৃষি খাতে প্রকৃত মজুরি কমেছে। সার্বিকভাবে কৃষিশ্রমিকদের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। যে মজুরি পান, তা দিয়ে কৃষিশ্রমিকের পক্ষে মানসম্পন্ন জীবন যাপন করা সম্ভব হচ্ছে না।

>

বিবিএসের জরিপের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে কৃষিশ্রমিক আছেন সাড়ে ৭৭ লাখ।

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ দেশে নারী কৃষিশ্রমিকেরা পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে দিনে গড়ে ৪২ টাকা কম আয় করেন। নারীরা মজুরি পান মাত্র ৩৪৬ টাকা। আর পুরুষেরা পান ৩৮৮ টাকা। চট্টগ্রাম বিভাগের কৃষিশ্রমিকেরা সবচেয়ে বেশি মজুরি পান। ওই বিভাগে দিনে ৪৫৪ টাকা মজুরি পাওয়া যায়। আর সবচেয়ে কম মজুরি মেলে খুলনা ও রাজশাহী বিভাগে। সেখানকার কৃষিশ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩৪৭ টাকা।

কৃষিশ্রমিকের গড় দৈনিক মজুরি ৩৮৬ টাকা হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বিবিএসের প্রকল্প পরিচালক আখতার হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, দৈনিক মজুরি হিসেবে ৩৮৬ টাকা ঠিকই আছে। দেখা যায়, ফসল তোলার সময় ৮০০ টাকায়ও কৃষিশ্রমিক পাওয়া যায় না। আবার বছরের অন্য সময়ে ৩০০ টাকায় শ্রমিক পাওয়া যায়। তিনি জানান, আরেক শ্রেণির কৃষিশ্রমিক আছেন, যাঁরা বছরভিত্তিক চুক্তিতে কাজ করেন। কৃষকের বাড়িতে তিনবেলা খাবার পান ওই শ্রমিকেরা। তাঁদের নগদ মজুরি বেশ কম। এসব কারণে গড় মজুরি কম।

পল্লি এলাকায় ৪ কোটি ৭০ লাখের বেশি নানা পেশার লোক আছেন। এর মধ্যে কৃষি খাতে আছেন ২ কোটি ৪৩ লাখ জন। আর সেবা ও শিল্প খাতে যথাক্রমে ১ কোটি ৪৪ লাখ ও ৮১ লাখ ৮৭ হাজার লোক নিয়োজিত আছেন।

কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী-পুরুষের মধ্যে নানা ধরনের বিভাজন আছে। কৃষি খাতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের তিন ভাগের এক ভাগই শ্রমিক, তাঁরা খেতখামারে খেটে খাওয়া মানুষ। এই সংখ্যা সাড়ে ৭৭ লাখ। এ ছাড়া ৮১ লাখ লোক নিজের জমিতে চাষাবাদ করেন। বাকি দেড় লাখের মতো লোক কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট কাজ করেন।

 বিবিএসের জরিপ বলছে, গ্রামের পরিবারগুলোর আয়ের উৎসগুলো বদলে যাচ্ছে। গ্রামের একটি পরিবার মাসে আয় করে ১৬ হাজার ৮৯৩ টাকা। তবে এই আয়ের দুই-তৃতীয়াংশই আসে অকৃষি খাত থেকে। কৃষি খাত থেকে আসে ৩৮ শতাংশ বা সাড়ে ৬ হাজার টাকা।


দুই-তৃতীয়াংশ কৃষিতে

 দেশে পল্লি এলাকায় পৌনে তিন কোটি পরিবার আছে। তাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ পরিবারই কৃষিকাজ ও পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। প্রতি পরিবার গড়ে আড়াই বিঘার মতো জমিতে চাষ করে থাকে। তবে এর মধ্যে আশঙ্কার বিষয় হলো, পৌনে ৩ কোটি পরিবারের মধ্যে ১ কোটি ৮৩ লাখ পরিবারের জমির মালিক কোনো নারী সদস্য নন।

কৃষিজাত পণ্যের বিপণনেও বেশ গলদ আছে। অর্ধেকের বেশি কৃষক পরিবারকে নিজের বাড়িতেই ধান, চালসহ বিভিন্ন ধরনের কৃষিপণ্য বিক্রি করতে হয়। মাত্র ১৮ শতাংশ পরিবারের সদস্যরা স্থানীয় হাটবাজারে গিয়ে কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারেন। যেহেতু কৃষকদের বাজারে গিয়ে পণ্য বিক্রির সুযোগ কম পান, তাই বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে পণ্য বিক্রি করতে হয় বলে বিবিএসের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।