'অস্বাভাবিক' দরপতনে আতঙ্ক শেয়ারবাজারে

দেশের শেয়ারবাজারের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরা প্রায় নিষ্ক্রিয়। ক্রমাগত ‘অস্বাভাবিক’ পতনে প্রতিদিনের বাজারে লেনদেনে অংশ নেওয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন বেশির ভাগ সাধারণ বিনিয়োগকারী। আর প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করছে বেশি। ফলে গতকাল রোববার আবারও শেয়ারবাজারে বড় ধরনের দরপতন ঘটে।

 দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৯৭ পয়েন্ট বা প্রায় ২ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৫ হাজার ৩৪ পয়েন্টে। ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বরের পর এটিই ডিএসইএক্সের সর্বনিম্ন অবস্থান। সূচক ৫ হাজারের কাছাকাছি চলে আসায় নতুন করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সব ধরনের বিনিয়োগকারী। বাজারের অবস্থা এতটাই খারাপ যে ভালো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেও লোকসান গুনছেন বিনিয়োগকারীরা।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, ১০ দিনের বেশি সময় ধরে শীর্ষ পর্যায়ের ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো বাজারে শেয়ার কেনার চেয়ে বিক্রি করছে বেশি।

বাজারের সাম্প্রতিক এ দরপতনকে ‘অস্বাভাবিক’ মনে করছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি)। অস্বাভাবিক পতনের কারণ অনুসন্ধানে গতকাল চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিএসইসির পরিচালক রেজাউল করিমকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটিকে বাজারের সাম্প্রতিক সময়ের অস্বাভাবিক পতন, লেনদেন কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

বিএসইসির মুখপাত্র সাইফুর রহমান তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও এ ধরনের দরপতন অনাকাঙ্ক্ষিত। এর পেছনে কোনো অনিয়ম কাজ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে তদারকি বাড়ানো হয়েছে।’

বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের দিক থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তাতে বাজারে সুফল আসেনি। যদিও এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু পদক্ষেপ দীর্ঘ মেয়াদে ভালো।

জানতে চাইলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বাজারে যখন মন্দাভাব চলছে, তখন এ ধরনের পদক্ষেপে ইতিবাচক প্রভাবের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাবই বেশি পড়েছে। যেসব কোম্পানির উদ্যোক্তাদের ৩০ শতাংশ শেয়ার নেই, সেসব কোম্পানি বোনাস লভ্যাংশ দিতে পারবে না বলে বিএসইসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রথমত মন্দা বাজারে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এটি ছিল না। দ্বিতীয়ত, উদ্যোক্তাদের ব্যর্থতার শাস্তি এসে পড়বে শেয়ারধারীর ওপর।

নানা কারণে পতন

বাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল দিনের শুরুতে বড় ধরনের দরপতন ঘটতে থাকলে ক্রেতাসংকট দেখা দেয়। সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও আতঙ্কিত হয়ে তাঁদের হাতে থাকা শেয়ার লোকসান দিয়ে বিক্রি করে দেন। আবার শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান জোরপূর্বক বিক্রি (ফোর্সড সেল) শুরু করে।

একাধিক মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের পর অনেক প্রতিষ্ঠান সফটওয়্যারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জোরপূর্বক বিক্রির সংকেত চালু করে। তাতে ঋণগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের দাম একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে নেমে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিক্রির সংকেত দেয়। ফলে গতকাল দরপতন শুরু হলে নতুন করে বেশ কিছু বিনিয়োগকারীর শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রির আওতায় চলে আসে।

ঢাকার বাজারে গতকাল এক দিনে সূচক যতখানি কমেছে, তা ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির পর শতাংশের হিসাবে সর্বোচ্চ। ওই দিন ডিএসইএক্স সূচকটি ২ দশমিক ২১ শতাংশ কমেছিল। আর গতকাল কমেছে প্রায় ২ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকে বাজারে প্রায় টানা দরপতন চলছে। ৩০ জুন বাজেট পাসের পর ১৪ কার্যদিবসে ডিএসইর প্রধান সূচকটি প্রায় ৪০০ পয়েন্ট কমে গেছে। এ পতনের পেছনে একগুচ্ছ দৃশ্যমান ও অদৃশ্য কারণ রয়েছে বলে জানান বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগকারীর আস্থার অভাব, ব্যাংক খাতে তারল্যসংকট, পাওনা আদায়ে তালিকাভুক্ত গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ, মানহীন কিছু কোম্পানির শেয়ার নিয়ে কারসাজি, পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের সিদ্ধান্ত, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বাজারসংশ্লিষ্টদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান, তালিকাভুক্ত কোম্পানির মুনাফা ও লভ্যাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা ইত্যাদি।

বিএসইসির সঙ্গে বিরোধ

সম্প্রতি কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের তালিকাভুক্তির ইস্যুতে ডিএসই ও বিএসইসির মধ্যে একধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। আর্থিক প্রতিবেদনে বড় ধরনের অসংগতি থাকায় কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্ত না করতে অনড় অবস্থান নেয় ডিএসই। কিন্তু বিএসইসি উল্টো প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর টাকা কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে জমার নির্দেশ দেয়। অন্যদিকে কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দিতে নানা পক্ষ থেকে ডিএসইর ওপর চাপ ও নানাভাবে ভয়ভীতিও দেখানো হয়। এ ইস্যুতে বিএসইসির অবস্থান নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে ডিএসইর সদস্যদের মধ্যে।

এ ছাড়া ১১ জুলাই ডিএসইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এ এম মাজেদুর রহমানের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ তাঁকে দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুমোদনের জন্য বিএসইসিতে পাঠায়। কিন্তু বিএসইসি এ বিষয়েও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এ নিয়েও ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদে ক্ষোভ রয়েছে। এ ছাড়া গত কয়েক বছরে মানহীন কিছু কোম্পানির আইপিও অনুমোদনের বিষয়টি নিয়েও বাজারসংশ্লিষ্টদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ রয়েছে। বিনিয়োগকারীরাও এ জন্য বিএসইসিকে দুষছেন। এমনকি বাজারের আস্থা ফেরাতে বিএসইসির চেয়ারম্যানেরও পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছেন বিনিয়োগকারীরা।

করণীয় কী

বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজারে যখন পতন শুরু হয়, তখনই তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়, কিন্তু সুফল খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না।

জানতে চাইলে ২০১০ সালে শেয়ারবাজার ধসের তদন্তে সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ‘আমাদের তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করা হয়নি। আমাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করা (ডিমিউচুয়ালাইজেশন) হলেও সেটি যথাযথভাবে হয়নি। আবার স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যসংখ্যাও ২৫০ জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্যসংখ্যা ন্যূনতম ১ হাজারে উন্নীত এবং পরিচালনা পর্ষদকে পুরোপুরি স্বাধীন করা না হবে, ততক্ষণ বাজারের নিয়ন্ত্রণ ঘুরেফিরে কিছু লোকের হাতেই থেকে যাবে। এ ছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকাও স্বচ্ছ নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নিয়ে লোকমুখে নানা ধরনের কথা শোনা যায়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা কী করছে, তা আমরা বাইরে থেকে জানতে পারছি না। এমন পরিস্থিতিতে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো কঠিন।’