বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল পেতে দেশ কতটা প্রস্তুত

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে নতুন শঙ্কায় এখন বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ এশিয়ার রপ্তানি বাজারে বড় প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। কমেছে চীন, সিঙ্গাপুর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও কোরিয়ার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর হোঁচট খাওয়ায় সামনে আরও খারাপ দিন আসছে বলেই বিশ্লেষকেরা মনে করছেন। 

এ রকম এক টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন এক মাইলফলক স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ। রপ্তানি আয় ৪ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বড় দেশগুলো বিপদে পড়লেও চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ বাংলাদেশের রপ্তানি আয় আরও বাড়বে বলেই আশা উদ্যোক্তাদের। তবে সুফল পুরোপুরি তুলে নিতে সরকারের প্রস্তুতির অভাব আছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন। 

বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এই বাজারে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারাও আগের চেয়ে আরও বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। নতুন ক্রেতারা আসা শুরু করেছেন। সব মিলিয়ে বড়দের বাণিজ্যযুদ্ধে সুফল পাচ্ছে ছোট অর্থনীতির বাংলাদেশ। একাধিক রপ্তানিকারক জানালেন, এমনকি ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া কিছু মার্কিন ক্রেতাও আবার বাংলাদেশে আসা শুরু করেছেন। আর কেবল পোশাক নয়, জুতা, প্লাস্টিক, সাইকেল, সিরামিক খাতেও মার্কিন ক্রেতাদের আনাগোনা বেড়েছে বলে জানা যাচ্ছে। 

ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলস (অটেক্সা) এখন পর্যন্ত গত মে মাসের তথ্য প্রকাশ করেছে। দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) যুক্তরাষ্ট্রে ২৫৫ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, আগের বছরের একই সময়ে যা ছিল ২২১ কোটি ডলার। তার মানে, পাঁচ মাসে রপ্তানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অথচ রানা প্লাজা ধসের পর যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি কমে গিয়েছিল। যেমন এর আগের চার অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। 

রপ্তানির নতুন মাইলফলক

সদ্যসমাপ্ত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। আগের অর্থবছরের আয় ছিল ৩ হাজার ৬৬৬ কোটি ডলার। রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। এ সময় রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ছিল ৩ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। ফলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও আয় বেশি হয়েছে ৩ দশমিক ৯৪ শতাংশ। রপ্তানি আয় ৪০ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় সুসংবাদ। এই আয়ের ৮৪ শতাংশই এসেছে পোশাক খাত থেকে। 

বাণিজ্যযুদ্ধের শঙ্কা ও সুফল 

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেছিলেন ২০১৮ সালে। পাল্টা আঘাত আসে চীনের পক্ষ থেকেও। আর বৃহৎ অর্থনীতির দুই দেশের যুদ্ধে সংকটে পড়ে গেছে অন্য অনেক দেশ। এই যুদ্ধ যত বেশি দিন ধরে চলবে, ক্ষতি ততই বাড়বে।

বিবিসি বলছে, এত দিন যাদের মনে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাব নিয়ে সংশয় ছিল, তাদের জন্য উত্তর হচ্ছে সিঙ্গাপুরের বাণিজ্য উপাত্ত। গত জুনে দেশটির রপ্তানি কমেছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। কেবল সিঙ্গাপুর নয়, একই মাসে ভারতের রপ্তানি কমেছে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ, এশিয়ায় চীনের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার ইন্দোনেশিয়ার কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ, আর দক্ষিণ কোরিয়ার রপ্তানি কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশ। এই দেশগুলো চীনের কাছে পাম তেল থেকে শুরু করে নানা ধরনের রাসায়নিক পণ্য এবং সেমিকন্ডাক্টর বিক্রি করে থাকে। মূলত, যারাই চীনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বেশি সম্পর্কিত, তারাই বিপদে আছে।

বাণিজ্যযুদ্ধে সবার ক্ষতি এমনটি কিন্তু নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন অতিরিক্ত শুল্ক বসানোর কারণে এসব পণ্যের রপ্তানি মূল্য বেড়ে গেছে। এ সুযোগে তৃতীয় আরেকটা দেশ সেসব পণ্য রপ্তানি করার সুযোগ পাচ্ছে। মার্কিন ক্রেতারাও চীনের পরিবর্তে অন্য দেশে যাচ্ছেন। জাপানের আর্থিক সেবা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান নমুরা সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সুফল পাচ্ছে ভিয়েতনাম। এরপরই আছে চিলি, মালয়েশিয়া, আর্জেন্টিনা, হংকং, মেক্সিকো, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল ও কানাডা। 

বাংলাদেশ কোথায়

নমুরার প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নেই। কারণ, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র যেসব পণ্য বিক্রি করে, তা বাংলাদেশ তেমন উৎপাদন করে না। তবে দেশের উদ্যোক্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। কারণ, এরই মধ্যে সুফল পাওয়া শুরু হয়েছে। ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার সময়েও বাংলাদেশ ভালো করেছিল। 

মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের ভালো করার মধ্যে বড় কোনো রহস্য নেই। বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। আর বাংলাদেশ মূলত নিত্যব্যবহার্য (বেসিক) পোশাকই বেশি রপ্তানি করে। এগুলো সস্তা, সব সময় চাহিদা থাকে, মন্দার সময় বরং চাহিদা আরও বাড়ে। আয় কমে যায় বলে অনেকেই উচ্চ ফ্যাশনের পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাক কেনা বাড়িয়ে দেয়। তবে বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বমন্দা দীর্ঘায়িত হলে এমনটা না–ও হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন। 

যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুফল পাওয়া দেশ ভিয়েতনাম। তবে ট্রাম্প হুমকি দিয়েছে রেখেছেন যে তাঁর পরের লক্ষ্য হবে ভিয়েতনাম ও তাইওয়ান। এতেই বাংলাদেশের অনুকূলে খানিকটা বাতাস বইছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। বাণিজ্যযুদ্ধ কতটা ছড়াবে, কেউই নিশ্চিত নন। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বিকল্প বাজার ঠিক করে রাখতে চাইছেন। এতেই বাড়ছে বাংলাদেশের কদর। 

বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা

প্রশ্ন উঠেছে, বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল তুলতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি কতটা। একাধিক উদ্যোক্তা জানালেন, তাঁরা প্রস্তুত। তবে প্রশ্ন রয়েছে সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে। 

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধকে বাংলাদেশ কীভাবে কাজে লাগাতে পারে, এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা বা কৌশলপত্র আছে কি না জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব মো. মফিজুল ইসলাম গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের সে ধরনের কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি এবং মনেও করি না যে নেওয়ার দরকার আছে।’ 

ভারত অনেক পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে, এ তথ্য জানালে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘তা নিতে পারে। ভারত অনেক বড় দেশ। আমরা মনে করি, আমাদের রপ্তানি যা বাড়ার নিজস্ব শক্তিতে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাড়বে। দুই দেশের বাণিজ্যযুদ্ধকে মাথায় রাখতে হবে না।’ 

>রপ্তানি আয়ের নতুন মাইলফলক ছুঁয়েছে বাংলাদেশ 
বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে আয় বাড়তে পারে
এ জন্য দরকার প্রস্তুতি


এদিকে, নতুন আদেশ পাওয়ার পাশাপাশি পণ্যের দামও কিছু বেড়েছে বলে উদ্যোক্তারা খুশি। রপ্তানির পরিমাণ বাড়লেও পণ্যের দাম কমে যাচ্ছে বলে পোশাকমালিকদের অভিযোগ বহুদিনের।  পোশাকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) হিসাবে, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া চীনা পোশাকের দর কমেছে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ, আর চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) সময়ে কমেছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে একই সময়ে বাংলাদেশের পোশাকের রপ্তানি মূল্য বেড়েছে যথাক্রমে ২ দশমিক ০৫ ও ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ। 

আবার বিজিএমইএর হিসাবেই, গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া পণ্যের গড় মূল্য ছিল ২ দশমিক ৩ ডলার, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ছিল ২ দশমিক ৭৯ ডলার। সুতরাং আরোপিত বাড়তি কর দিলেও চীনের পোশাক সস্তাই থেকে যায়। 

এ পরিস্থিতে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ যে সুফল পাচ্ছে, তা হয়তো তাৎক্ষণিক ও স্বল্পমেয়াদি। এ পরিস্থিতি বদলে যেতে পার। বাণিজ্যযুদ্ধ দীর্ঘ হলে বিশ্বমন্দার আশঙ্কা থাকবে। তাতে অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাহিদা কমে যাবে। এতে বাংলাদেশেরই ক্ষতি। ২০০৮ সালের মন্দায় লাভবান হলেও এবার পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারে। 

তাহলে করণীয় কী—এ বিষয়ে সেলিম রায়হান বলেন, অন্যভাবে বাংলাদেশ বেশি লাভবান হতে পারে। যেমন বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে প্রচুর চীনা কোম্পানি অন্য দেশে চলে যাবে, যাকে অর্থনীতিতে রি-অ্যালোকেট বলে। এসব চীনা কোম্পানিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে হবে। এতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ অনেক বাড়বে। এখন এসব কোম্পানি বেশি যাচ্ছে ভিয়েতনামে। দেশটি এরই মধ্যে ইইউর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করেছে। ফলে তাদের সুযোগ অনেক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ বিশেষ করে উৎপাদন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ তেমন আনতে পারছে না। সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে, তবে অগ্রগতি খুবই শ্লথ। সেখানে যেসব বিনিয়োগ যাচ্ছে, তার বড় অংশই দেশের এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া। সুতরাং সরকারকে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আনতে অনেক বেশি তৎপর হতে হবে। 

একই কথা বললেন রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা বেশি বেশি আদেশ পাচ্ছি ঠিকই, তবে চীনের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আনতে পারলে সেটাই বেশি লাভজনক হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার অনেক আন্তরিক, তবে উদ্যোগ নেই। এটাই সমস্যা।’