ছোট দেশ শক্তিশালী অর্থনীতি

>

ঢাকা শহরের ধানমন্ডি, মিরপুর কিংবা উত্তরায় যত মানুষ থাকে, সেসব দেশে থাকে তার চেয়েও কম। অথচ সেসব দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। সেগুলোর অনেক দেশ উপভোগ করে উন্নত অর্থনৈতিক সুবিধা। ছোট অর্থনীতির এই দেশগুলো বেশির ভাগের অবস্থানই ইউরোপ, ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিল আর অমিলগুলো নিজেরাই খুঁজে দেখুন।

ভ্যাটিকান সিটির প্যানারোমিক দৃশ্য। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
ভ্যাটিকান সিটির প্যানারোমিক দৃশ্য। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


১. ভ্যাটিকান সিটি
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম জাতীয় রেলওয়ে ব্যবস্থা রয়েছে এই দেশে, রয়েছে পৃথিবীর একমাত্র ল্যাটিন ভাষার ফিচার লেখা এটিএম বুথ। এখানেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গির্জা সেন্ট পিটার্স প্যাসিলিকা। তাই পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে প্রথম স্থানে থাকা দেশ ভ্যাটিকান সিটির সবকিছুই যে ছোট, সেটা বলতে পারবে না কেউ।

ভ্যাটিকান সিটির মোট আয়তন মাত্র শূন্য দশমিক ৪৪ বর্গকিলোমিটার এবং এর জনসংখ্যা মাত্র ১০০০। ইতালির রাজধানী রোমের মধ্যে অবস্থিত স্বাধীন দেশটিকে দেশ না বলে শুধু সিটি বলা হয় এর আকৃতির কারণে। আর বিখ্যাত ইতালিয়ান চিত্রকর মিকাইল অ্যাঙ্গেল পিএতের ছবি এবং ‘দ্য ক্রিয়েশন অব অ্যাডাম’ রাখা আছে এই বিখ্যাত গির্জায়। এ ছাড়া দেশটি রোমান ক্যাথলিক গির্জার বিশ্ব সদর দপ্তর হিসেবে কাজ করায় একে পবিত্র দেশও বলা হয়ে থাকে আর মহামান্য পোপ হলেন দেশটির রাষ্ট্রনেতা।

দেশটির প্রধান আয়ের উৎস হলো অনুদান এবং যার পুরোটাই আসে রোমান ক্যাথলিক ধর্মের বিলিয়নিয়ার অনুসারীদের কাছ থেকে। এ ছাড়া সম্পূর্ণ দারিদ্র্যমুক্ত এই দেশটির বার্ষিক জিডিপি প্রায় ২১ হাজার ১৯৮ ডলার। তাই এই দেশের সাধারণ মানুষের গড় আয় এবং জীবনযাত্রার মান উভয়ই যথেষ্ট ভালো। এ ছাড়া দেশটিতে একটি মহাকাশ অবজারভেটরি এবং লাইব্রেরি ভ্যাটিকানা নামে একটি লাইব্রেরি আছে। তা ছাড়া এই দেশের সুন্দর সুন্দর বাড়ি খুব সহজেই সাধারণ পর্যটকদের মন আকর্ষণ করে।

মোনাকো সিটি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
মোনাকো সিটি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


২. মোনাকো
পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে পশ্চিম ইউরোপের ফ্রেঞ্চ রিভিএরায় অবস্থিত মোনাকো। এর তিন পাশেই রয়েছে ফ্রান্স এবং এক পাশে রয়েছে ভূমধ্যসাগর। সরকারিভাবে কোনো রাজধানী না থাকলেও দেশটির সবচেয়ে বিত্তশালী চতুর্থাংশ মন্টে-কারলোকেই এর প্রধান শহর বা কেন্দ্র মনে করা হয়ে থাকে। এর রাজভাষা হলো ফরাসিদের ভাষা ফ্রেঞ্চ। সমুদ্রের তীরে অবস্থিত দেশটির মোট আয়তন মাত্র ২ দশমিক শূন্য ২ বর্গকিলোমিটার এবং মোট জনসংখ্যা ৩৮ হাজার। তবে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৮ হাজারের বেশি হওয়ায় ঘনত্বের বিচারে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ।

পর্যটনশিল্পই এই দেশের প্রধান চালিকা শক্তি। দেশটিতে রয়েছে অনেক বিত্তশালী লোকের বাস। তাই দেশটির মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ প্রায় ১১৫ হাজার ৭০০ ডলার। মোনাকোর প্রধান আকর্ষণ ক্যাসিনো। এ কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত জুয়াড়িরা এখানে আসে জুয়া খেলতেন। জুয়াড়িদের ভোগবিলাসের জন্য খুবই বিখ্যাত এই দেশ। আর এই দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্যাসিনো মোন্টে-কারলো ক্যাসিনো, এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৬ সালে। দেশটির মোট বার্ষিক রাজস্বের প্রায় ১৫ শতাংশ আসে এই পর্যটনশিল্প থেকে। এ ছাড়া বিখ্যাত ফর্মুলা-ওয়ান রেশের জন্য ট্রাক চলে গেছে এই ছোট দেশের ওপর দিয়ে।

নাউরুর এরিয়াল ভিউ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
নাউরুর এরিয়াল ভিউ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


৩. নাউরু
কোন গণতান্ত্রিক দেশের রাজধানী নেই—এ রকম কোনো প্রশ্নের উত্তর হবে নাউরু। হ্যাঁ, পৃথিবীর একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নাউরু, যার কোনো রাজধানী নেই। শুধু তা–ই নয়, এর নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনীও নেই। এটি পৃথিবীর তৃতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ। নাউরুকে একসময় ‘প্লেজেন্ট আইল্যান্ড’ নামেও ডাকা হতো। ওশেনিয়া মহাদেশে অবস্থিত দেশটির মোট আয়তন মাত্র ২১ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার। এর মোট জনসংখ্যা প্রায় ১১ দশমিক ৫ হাজার। এই দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষই শিক্ষিত। ১৯৭০-৮০–এর দশকে দেশটিতে ছিল ফসফেট খনির রমরমা ব্যবসা। সে সময় নাউরুর অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত ভালো। পরবর্তী সময়ে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে এবং ফসফেটের প্রাথমিক স্তরের মজুত কমে যাওয়ার ফলে এখন এর অর্থনৈতিক অবস্থা আর আগের মতো নেই। বর্তমানে দেশটির মাথাপিছু আয় ১৪ হাজার ১৫৮ ডলার। বর্তমানে নাউরুর অর্থনীতির মূল উৎস হলো ফসফেট মাইনিং, অফসোর ব্যাংকিং, মৎস্য শিকার ও বৈদেশিক সহায়তা। দ্বিতীয় স্তরের ফসফেটের মজুত আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে নাউরু আবার অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়ে উঠছে।

টুভালুর রাজধানী ফুনাফুটির একটি হ্রদ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
টুভালুর রাজধানী ফুনাফুটির একটি হ্রদ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


৪. টুভালু
একটি স্বাধীন দেশে রয়েছে মাত্র ৮ কিলোমিটার রাস্তা আর একটিমাত্র হাসপাতাল! এ ছাড়া এখনো প্রাচীন কমিউনিটির ধারণা টিকে আছে পৃথিবীর চতুর্থ ক্ষুদ্রতম দেশ টুভালুতে। এখানকার মানুষ সবাই নিজের কমিউনিটির জন্য নির্দিষ্ট কাজ করে থাকে। যেমন যারা মাছ ধরে, তারা শুধু নিজেদের জন্যই মাছ ধরে না। সবার জন্যই মাছ ধরে। এখনো তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য ফালেকাপুলে বা মানেয়াকা নামে তাদের মিটিং হলে জড়ো হয়। টুভালুতে কোনো রেল যোগাযোগ নেই। তবে সমুদ্রযাত্রার দক্ষতার জন্য পৃথিবীজোড়া পরিচিতি রয়েছে এই দেশের।

টুভালু পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত একটি পলিনেসিয়ান দ্বীপদেশ। হাওয়াই ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অবস্থিত এই দেশ মূলত ৯টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। এর মোট আয়তন মাত্র ২৬ বর্গকিলোমিটার। এটি আগে এলিস দ্বীপপুঞ্জ নামেও পরিচিত ছিল। ১৯৭৫ সালে এটি গিলবার্ট দ্বীপপুঞ্জ থেকে আলাদা হয় এবং এর ৩ বছর পর ১৯৭৮ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এর জনসংখ্যা প্রায় ১০ হাজার এবং রাজধানীর নাম ফুনাফুটি। দেশটি পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর অন্যতম। এর মাথাপিছু আয় মাত্র ৩ হাজার ৯২৫ ডলার।

টুভালুর মূল অর্থনৈতিক উৎস মাছ ধরার লাইসেন্স বিক্রি, টুভালু ট্রাস্ট ফান্ডের অনুদান, ডট টিভি (.tv) নামে টপ লেভেল ইন্টারনেট ডোমেইন বিক্রি।

মাউন্ট টাইটানোর ওপর গোয়াইট দুর্গ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
মাউন্ট টাইটানোর ওপর গোয়াইট দুর্গ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


৫. সান-ম্যারিনো
পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থানে রয়েছে ইউরোপের দেশ সান-ম্যারিনো। অ্যাপেনাইন পর্বতের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত এই দেশ ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো গণরাজ্য বলে পরিচিত। অনেকেই একে ‘টাইটানিক রিপাবলিক’ বলে ডেকে থাকে। ইউরোপ মহাদেশের তৃতীয় ক্ষুদ্রতম এই দেশের আয়তন মাত্র ৬১ বর্গকিলোমিটার, যার চারদিকে রয়েছে ইতালি। এর মোট জনসংখ্যা ৩৩ হাজার আর মাথাপিছু আয়ের হিসাবে এটি ইউরোপের অন্যতম ধনী দেশ। এর বর্তমান মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ প্রায় ৫৯ হাজার ৫০০ ডলার। দেশটিতে বেকারত্ব নেই বললেই চলে। সান-ম্যারিনো পৃথিবীতে শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে পরিচিত।

সান-ম্যারিনোর জিডিপি ও জীবনযাত্রার মান ইতালির সঙ্গে তুলনীয়। এ দেশের মূল অর্থনৈতিক উৎস ব্যাংকিং সেবা, ইলেকট্রনিক দ্রব্যাদি তৈরি, সিরামিকস ও পর্যটনশিল্প। দেশটিতে একটিমাত্র পাহাড় রয়েছে মাউন্ট টাইটানো নামে। এর উচ্চতা ২ হাজার ৪২৫ ফুট।

হিলটি করপোরেশনের সদর দপ্তর, শান, লিচটেনস্টেইন। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
হিলটি করপোরেশনের সদর দপ্তর, শান, লিচটেনস্টেইন। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


৬. লিচটেনস্টেইন
প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও একটি দেশ যে বিশ্বের অন্যতম ধনী হয়ে উঠতে পারে, তার উদাহরণ লিচটেনস্টেইন। ২০০৮ সালে এ দেশের রাজা বিশ্বের অষ্টম ধনী রাজার মর্যাদা পেয়েছিলেন। তখন তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার! অথচ এই ‘ল্যান্ডলক’ দেশটি বিশ্বের ষষ্ঠ ক্ষুদ্রতম এবং ইউরোপের চতুর্থ ক্ষুদ্রতম দেশ। এ দেশের নাগরিকেরা জীবনযাত্রার মানের ক্ষেত্র বিশ্বের সর্বোচ্চ মান উপভোগ করে থাকেন। লিচটেনস্টেইন পৃথিবীর অল্প কয়েকটি দেশের অন্যতম, যাদের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি নিবন্ধিত কোম্পানি রয়েছে! এ দেশের রয়েছে কার্যকরী ও শক্তিশালী একটি অর্থনৈতিক সেবা সেক্টর।

লিচটেনস্টেইনের মোট আয়তন মাত্র ১৬০ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ৩৮ হাজার। এর দক্ষিণ ও পশ্চিমে রয়েছে সুইজারল্যান্ড এবং পূর্বে রয়েছে অস্ট্রিয়া। এর রাজধানী হলো ওয়াডুজ এবং এর বৃহত্তম শহর হলো শানান। মাথাপিছু আয়ের হিসাবে এটি পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ। এর বর্তমান মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ প্রায় ১৩৯ হাজার ১০০ ডলার। এখনো রাজতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা বহাল রয়েছে এ দেশে। লিচটেনস্টেইনের রাষ্ট্র ভাষা জার্মান।

অর্থনৈতিকভাবে দেশটি ক্রয়ক্ষমতার বিচারে বিশ্বের অন্যতম ‘হাইয়েস্ট গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্টস পার পারসন’ হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্ববিখ্যাত ‘হিলটি’ করপোরেশন লিচটেনস্টেইনে অবস্থিত। টেক্সটাইল, ইলেকট্রনিকস, ওষুধ, খাদ্য ও অন্যান্য ভারী শিল্পে সমৃদ্ধ লিচটেনস্টেইনের অর্থনীতির অন্যতম উৎস পর্যটনশিল্প।

মার্শাল আইল্যান্ড। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
মার্শাল আইল্যান্ড। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


৭. মার্শাল আইল্যান্ড
পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপদেশ মার্শাল আইল্যান্ড। ১৭৮৮ সালে এই দ্বীপে এসেছিলেন ব্রিটিশ অভিযাত্রী জন মার্শাল। তাঁর নাম অনুসারে এই দ্বীপের নাম হয় মার্শাল আইল্যান্ড। ১৯৪৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন থেকে এর সুরক্ষার দায়িত্বে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর মোট আয়তন মাত্র ১৮১ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার এবং এর মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫৪ হাজার। এই দেশের রাজধানীর নাম হলো মাজুরো এবং এখানকার প্রচলিত মুদ্রা হচ্ছে ইউএস ডলার। ছোট এই দেশের মাথাপিছু আয় মাত্র ৪ হাজার ৪০ ডলার। ১৯৪২ সালে গঠিত এই দ্বীপপুঞ্জের বেশির ভাগ মানুষই মার্শালিজ বংশোদ্ভূত। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফিলিপাইন এবং অন্যান্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অল্পসংখ্যক অভিবাসী রয়েছেন মার্শাল আইল্যান্ডে। ঐতিহাসিকভাবে এই দ্বীপের বাসিন্দারা ‘জোলেট জেন আঞ্জ’ বা ঈশ্বরের উপহার হিসেবে পরিচিত।

মার্শাল আইল্যান্ডের অর্থনীতির মূল উৎস এ দেশের সীমিত পরিমাণের প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষিপণ্য, টুনা মাছ প্রসেসিং, পর্যটনশিল্প এবং শিপিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। আমেরিকার অধীনে থাকার কারণে মার্শাল আইল্যান্ড আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি আন্তর্জাতিক নৌবাণিজ্যের ‘ফ্লাগ অব কনভেনিয়েন্স’ নিয়মের আওতায় সুবিধাপ্রাপ্ত একটি দেশ। যে কারণে এই দেশে কোনো তেল শোধনাগার না থাকার পরেও দেশটি অপরিশোধিত তেল আমদানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের নেভিস দ্বীপ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের নেভিস দ্বীপ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


৮. সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস
আপনি যদি বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২ কোটি সাড়ে ১২ লাখ টাকা বা ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার এখানকার চিনিকলে বিনিয়োগ করেন অথবা ৪ লাখ ডলার বা আনুমানিক ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকার জমি কেনেন, তাহলে ছবির মতো সুন্দর সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস নামের দেশটিতে নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে অষ্টম স্থানে থাকা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের এই দেশের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উৎস এই ইকোনমিক নাগরিকত্ব প্রোগ্রাম। সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের অন্য নাম ফেডারেশন অব সেন্ট ক্রিস্টোফার অ্যান্ড নেভিস। পৃথিবীর পশ্চিম গোলার্ধের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত এই দেশ মূলত দুই ক্যারিবিয়ান দ্বীপ সেন্ট কিটস এবং নেভিসের সমন্বয়ে গঠিত। এর মোট আয়তন মাত্র ২৬১ বর্গকিলোমিটার এবং এর মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫৪ হাজার। দেশটির মাথাপিছু আয় প্রায় ২৬ হাজার ৮০০ ডলার। এর রাজধানীর নাম ব্যাসেটারে, যেটি এই দেশের সবচেয়ে বড় শহরও বটে। এটি একসময় ইউরোপিয়ানদের দখলে ছিল। তাই এখানে ব্রিটিশ সভ্যতার ছাপ স্পষ্ট। এখানকার বাগানওয়ালা রিসোর্ট আর সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে সবাইকে। সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের আয়ের প্রধান উৎস হলো পর্যটনশিল্প। এ ছাড়া কৃষি এবং হালকা শিল্পকারখানা এই দেশের অর্থনীতির বড় উৎস।

নিউই–এর উপকূল। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
নিউই–এর উপকূল। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


৯. নিউই
পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে নবম স্থানে রয়েছে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ দেশ নিউই। ছোট এই দ্বীপদেশ ‘দ্য রক’ নামেও পরিচিত। ওশেনিয়া মহাদেশের নিউজিল্যান্ডের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই দেশের আয়তন মাত্র ২৬১ দশমিক ৪৬ বর্গকিলোমিটার এবং এর মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ হাজার ১৯০ জন। এর মাথাপিছু আয় প্রায় ৫ হাজার ৮০০ ডলার। এই দেশের রাজধানী হলো একটি গ্রাম, যেখানে ৬০০–এর বেশি মানুষ বাস করে। এই দেশে রয়েছে তাদের নিজস্ব এয়ারপোর্ট এবং একটি সুপার মার্কেট, যা পুরো দেশে মাত্র একটিই। এ ছাড়া দেখার মতো অনেক দারুণ দৃশ্য থাকা সত্ত্বেও দেশটি ভ্রমণের জন্য খুব একটা বিখ্যাত নয়।

নিউইর অর্থনীতি খুবই ছোট। জয়েন্ট ভেঞ্চার, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স, বৈদেশিক সহায়তা, ইন্টারনেটের টপ লেভেল ডোমেইন বিক্রি (.nu), কৃষি ও পর্যটনশিল্প নিউইর অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।

মালদ্বীপের রাজধানী মালে। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
মালদ্বীপের রাজধানী মালে। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


১০. মালদ্বীপ
প্রাচীনকালে মুদ্রার পরিবর্তে যে ‘কড়ি’ ব্যবহার করা হতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, মালদ্বীপ তার বেশির ভাগের জোগান দিত। ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, আফ্রিকাতেও যেত মালদ্বীপের কড়ি। এ কারণে দ্বিতীয় শতকে মালদ্বীপকে ‘মানি আইল্যান্ড’ নামে ডাকা হতো।

পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে ১০ম স্থানে রয়েছে ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশ মালদ্বীপ। এর রাজধানীর নাম মালে। পুরো এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে ছোট এই দেশের মোট আয়তন মাত্র ৩০০ বর্গকিলোমিটার এবং এর জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার। তবে ছোট এই দেশের মাথাপিছু আয় প্রায় ১৬ হাজার ৬৬৯ ডলার। দেশটিতে রয়েছে প্রায় ১ হাজার ১৯২টি প্রবালদ্বীপ। তবে এই সব কটি দ্বীপ কিন্তু এক জায়গায় নেই, ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার জায়গা বিস্তৃত করে। প্রবালদ্বীপগুলোর এমন বিক্ষিপ্ত অবস্থানই মালদ্বীপকে পৃথিবীর বুকে অন্যতম এবং বৈচিত্র্যময় দ্বীপরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেতে সাহায্য করেছে। বিভিন্ন সময়ে এই মালদ্বীপেই আস্তানা গেড়েছিল পর্তুগিজ, ডাচ ও ব্রিটিশরা। ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি। প্রতিবছর এখানকার সাদা বালুর সৈকত এবং সমুদ্রের নীল জল দেখার টানে ভিড় জমান লাখো পর্যটক।

মৎস্য শিকার মালদ্বীপের আয়ের বড় উৎস। এ ছাড়া পর্যটন এবং স্থানীয় তৈরি হস্তশিল্প বিদেশে বিক্রি করাও মালদ্বীপের অর্থনৈতিক আয়ের খাত।

মাল্টা গ্র্যান্ড হারবার। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
মাল্টা গ্র্যান্ড হারবার। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


১১. মাল্টা
আরও ৩২টি দেশের সঙ্গে ‘উন্নত অর্থনীতি’র দেশ হিসেবে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে ১১তম স্থানে থাকা মাল্টাকে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মনিটরি ফান্ড। এটি ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত দক্ষিণ ইউরোপের একটি দেশ। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এই দেশ। প্রধানত তিনটি দ্বীপকে একসঙ্গে করে তৈরি হওয়া দেশটির মোট আয়তন মাত্র ৩১৬ বর্গকিলোমিটার। তবে ক্ষুদ্র দেশ হলেও এর জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ লাখ, যার জন্য ঘনত্বের বিচারে মাল্টা হয়ে উঠেছে পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল দেশ। পর্যটকদের আকর্ষণ করে এখানকার ঝলমলে আবহাওয়া এবং হাতছানি দেয় শত শত বছরের পুরোনো ইতিহাস। এর রাজধানীর নাম ভালেত্তা। এখানকার প্রচলিত মুদ্রা ইউরো। তবে ছোট দেশটির মাথাপিছু আয় প্রায় ৪৫ হাজার ৬০৬ ডলার।

মাল্টার অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো বৈদেশিক বাণিজ্য—এই দেশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নৌবাণিজ্যের শিপমেন্ট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারিং এবং পর্যটনশিল্প।

গ্রেনাডার রাজধানী সেন্ট জর্জ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
গ্রেনাডার রাজধানী সেন্ট জর্জ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


১২. গ্রেনাডা
পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে ১২ম স্থানে রয়েছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ গ্রেনাডা। আরেক ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর উত্তর–পশ্চিম কোণে এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলার উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত এই দ্বীপ ‘স্পাইস আইল্যান্ড’ নামেও পরিচিত।

এর মোট আয়তন মাত্র ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার এবং এর মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার। ১৬৪৯ থেকে ১৭৬৩ সাল পর্যন্ত এই দেশ ফরাসিদের অধীনে থাকায় এখানে ফরাসি সংস্কৃতির গভীর প্রভাব রয়েছে। পুরো দেশটিতে ছড়িয়ে রয়েছে ফরাসি সভ্যতার নানা নিদর্শন এবং এখানকার লোকজনের মধ্যে রয়েছে ফরাসি হাবভাব।

দেশটির অর্থনীতি পর্যটনশিল্পের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। তাই প্রতিবছরই এখানে পর্যটকদের ভিড় দেখা যায়। দেশটির মাথাপিছু আয় প্রায় ১৪ হাজার ৭০০ ডলার। পর্যটনের পর কৃষি এ দেশের অর্থনীতির অন্যতম উৎস। গ্রেনাডাতে প্রচুর মসলার চাষ হয়। জায়ফল-জয়ত্রী উৎপাদনে গ্রেনাডা পৃথিবীতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

পালাও প্রজাতন্ত্রের চুনাপাথরের দ্বীপ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
পালাও প্রজাতন্ত্রের চুনাপাথরের দ্বীপ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


১৩. পালাও প্রজাতন্ত্র
পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে ১৩তম স্থানে রয়েছে ওশেনিয়া মহাদেশে অবস্থিত পালাও প্রজাতন্ত্র। দেশটি মূলত গড়ে উঠেছে ৩০০–এর বেশি বিভিন্ন আকৃতির ও আয়তনের দ্বীপ নিয়ে। দেশটির মোট আয়তন মাত্র ৪৫৯ বর্গকিলোমিটার এবং এর মোট জনসংখ্যা প্রায় ২১ হাজার ৩৪৭ জন। পালাও প্রজাতন্ত্রের মাথাপিছু আয় প্রায় ১৬ হাজার ৭০০ ডলার। রেইনফরেস্ট, ভিন্নধর্মী গাছপালা, পাখি ও স্বচ্ছ নীল জলের সমন্বয়ে গঠিত এই সুন্দর দেশ। এ ছাড়া এটি পৃথিবীর অন্যতম শান্তিময় দেশও বটে। এই দেশের পানিতে দেখতে পাওয়া যায় বিলুপ্তপ্রায় ১৩০ প্রজাতির হাঙর। তবে এখানকার সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান হচ্ছে হ্রদগুলো, যেখানে রয়েছে লাখ লাখ জেলি ফিশ। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই জেলি ফিশগুলো তাদের হুল ফুটানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। 

পালাও প্রজাতন্ত্রের অর্থনীতির মূল হচ্ছে পর্যটনশিল্প, কৃষি ও সামুদ্রিক মৎস্যশিকার।

পৃথিবীর মানচিত্রে খুব একটা চোখে না পড়লেও নিজস্ব স্বকীয়তা ও সংস্কৃতির কারণে প্রতিটি ক্ষুদ্র দেশই আলাদা একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে পৃথিবীর বুকে। অসাধারণ এ দেশগুলো সম্পর্কে জানা উচিত আমাদের সবারই।