এত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালানোর দক্ষ এমডি দেশে নেই

আরিফ খান
আরিফ খান
>

আবাসন খাতের জন্য নতুন একটি ঋণ চালু করেছে আইডিএলসি ফাইন্যান্স। পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন, তারল্যসংকটে যখন আর্থিক খাতে দুরবস্থা চলছে, তখন স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য নতুন এই ঋণ চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নতুন ঋণ, আর্থিক খাতের বর্তমান অবস্থা, করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন আইডিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী আরিফ খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন

প্রথম আলো: আমরা জেনেছি, সম্প্রতি আপনারা সাশ্রয়ী বা সহজলভ্য গৃহঋণ কর্মসূচি চালু করেছেন। আগে থেকেই তো আপনাদের গৃহঋণ ছিল। নতুন করে আবার এ ঋণ চালু করলেন কেন?

আরিফ খান: প্রথমত, বাসস্থান হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি। তাই আমরা সাধারণ চাকরিজীবী, স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সহজলভ্য গৃহঋণের নতুন এ ঋণ চালু করেছি। যাঁদের মাসিক আয় ২০ থেকে ৬০ হাজার টাকা, তাঁরাও এ ঋণসুবিধা পাবেন। আমরা দেখেছি, দেশে এমন অনেক স্বল্প আয়ের মানুষ আছেন, যাঁরা মাসে ২০ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেন। তাঁদের বেশির ভাগই সারা জীবন ভাড়া বাসায় কাটিয়ে দেন। সেসব মানুষ যাতে ভাড়ার টাকায় নিজের একটা বাসস্থান গড়তে পারেন, সে জন্য নতুন ঋণটি চালু করা হয়েছে। এ ঋণের সুদহার বাণিজ্যিক ঋণের চেয়ে সব সময় ১ থেকে ২ শতাংশ কম থাকবে। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলে আবেদনকারীদের এক সপ্তাহের মধ্যে ঋণের টাকা দেওয়া হবে। ভারতে এ ধরনের ঋণ বেশ জনপ্রিয়। আগে আবাসন খাতের জন্য আমাদের যে ঋণ ছিল, সেটি উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের জন্য। তাই এখন নতুন করে একেবারে সাধারণ মানুষের জন্য এ ঋণ চালু করা হয়েছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ঋণের বড় একটি অংশই যায় আবাসন খাতে। নতুন এ ঋণ চালুর পাশাপাশি চলতি বছর আবাসন খাতে এক হাজার কোটি টাকা অর্থায়নের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। আমরা দেখেছি, আবাসনে দেওয়া ঋণ খেলাপির পরিমাণ সবচেয়ে কম।

প্রথম আলো: বিশেষ কোনো জনগোষ্ঠী বা এলাকাকে টার্গেট করেই কি এ ধরনের ঋণ চালু করেছেন?

আরিফ খান: এ ক্ষেত্রে ঢাকার বাইরের শিল্পাঞ্চল এলাকা, দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গে এ ঋণ বেশি দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। যেখানে মানুষের আয়ের সুনির্দিষ্ট উৎস রয়েছে। গাজীপুরের মতো এলাকায় পোশাককর্মীদের জন্য কেউ যদি বড় ধরনের কোনো আবাসন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসেন, তাহলে আমরা সেখানে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করব।

প্রথম আলো: আবাসন খাতকে তো অনুৎপাদনশীল খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই অনুৎপাদনশীল খাতকে কেন অর্থায়নের জন্য বেছে নিলেন?

আরিফ খান: আমাদের দেশে এখনো আবাসন খাতকে অনুৎপাদনশীল খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, আমাদের আবাসন খাত এখনো ঢাকা ও চট্টগ্রামনির্ভর। আবাসন খাতের যেকোনো কাজের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে অনেক খাত জড়িয়ে আছে। তাই এ খাতের অগ্রগতি হলে তার প্রভাব অনেক খাতের ওপর পড়ে। কিন্তু আবাসন এখনো ঢাকা ও চট্টগ্রামনির্ভর হওয়ায় সেই সুফল আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এ কারণে আমরা ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে অন্যান্য জেলা শহরকে টার্গেট করেছি সহজলভ্য গৃহঋণ বিতরণের জন্য।

প্রথম আলো: আমরা দেখলাম, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর কোনো প্রভাব আপনাদের ওপর পড়েছে কি?

আরিফ খান: পিপলস লিজিং অবসায়নের সিদ্ধান্তের প্রভাব এ খাতের সবার ওপরই কমবেশি পড়েছে। এ সিদ্ধান্তের পর সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন গ্রাহকেরা। অনেক গ্রাহক তাঁদের আমানত নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। পিপলস লিজিংয়ের ঘটনা থেকে আমরা যেটা বুঝতে পারি, তা হলো প্রতিষ্ঠানটি আমানতকারীর আমানতের হেফাজত করতে পারেনি। তাই আমানতকারীদের দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। পিপলস লিজিং কিন্তু রাতারাতি খারাপ হয়ে যায়নি। অনেক আগে থেকেই প্রতিষ্ঠানটি একটু একটু করে খারাপ হয়েছে। আমি মনে করি, সমস্যার শুরুতে যদি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেত, তাহলে হয়তো প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়নের পথ বেছে নিতে হতো না। তবে যা ঘটে গেছে, সেটাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমাদের সবার জন্য এটি একটি উদাহরণ। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সামনে এগোতে হবে।

প্রথম আলো: পিপলস লিজিংয়ের এ অবস্থা হলো কেন? কারা দায়ী এ জন্য।

আরিফ খান: আমি বলব, সুশাসনের অভাব, সঠিক নেতৃত্বের ঘাটতি, দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণেই প্রতিষ্ঠানটি খারাপ হয়েছে। এ ছাড়া যাঁরা এটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল। একটি প্রতিষ্ঠান যখন খারাপ হতে শুরু করে, সবার আগে সেটি টের পান যিনি প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার শীর্ষ পদে রয়েছেন, তিনি। এ ছাড়া পরিচালনা পর্ষদেরও বিষয়টি জানার কথা। যেকোনো ব্যবসায় ভালো-মন্দ থাকে। যৌক্তিক কারণেও অনেক প্রতিষ্ঠান খারাপ হতে পারে। কিন্তু ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব সময়মতো প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। সেখানে যদি ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য অসৎ হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠান আরও খারাপ হবে। আমার ধারণা, পিপলস লিজিংয়ের ক্ষেত্রে সুশাসনের বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। পেশাদারিরও অভাব ছিল। তা না হলে লাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যেতে পারে না।

প্রথম আলো: কিন্তু দেশে যত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, সেগুলো পরিচালনার মতো দক্ষ ও পেশাদার জনবল কি আছে?

আরিফ খান: আমি বলব, আমাদের দক্ষ জনবলের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আমার তো মনে হয়, এত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মতো দক্ষ, সৎ ও পেশাদার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বা প্রধান নির্বাহীই নেই আমাদের দেশে। অন্যান্য পর্যায়ের জনবল-ঘাটতি তো আছেই। এ কারণে দেখা যাচ্ছে, এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ বেতনে দক্ষ লোক নিয়ে যাচ্ছে। তাতে ব্যবস্থাপনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। আবার প্রতিষ্ঠান বেশি হওয়ায় আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রেও একধরনের অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এতে দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই আমি মনে করি, আমাদের দেশে আর্থিক খাতের জন্য একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ ব্যবস্থা চালু করা দরকার।

প্রথম আলো: প্রধান নির্বাহী হিসেবে আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানে কতখানি পেশাদারির চর্চা করতে পারছেন। পরিচালনা পর্ষদের কি কোনো হস্তক্ষেপ নেই?

আরিফ খান: এ ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি, হয়তো আমি কিছুটা সৌভাগ্যবান অন্য অনেকের তুলনায়। কারণ, আমার প্রতিষ্ঠানে সৎ, দক্ষ এবং সমাজে ও দেশে সুনাম রয়েছে এমন মানুষ পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন। যাঁরা নিজেদের ব্যবসায় বেশ সফল, প্রতিষ্ঠিত ও সুনামের অধিকারী। যার কারণে তাঁরা এই প্রতিষ্ঠানের সব সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেন না। তাঁরা চান, প্রতিষ্ঠান ভালো চলুক, বছর শেষে শেয়ারধারীদের ভালো লভ্যাংশ যেন দেওয়া যায়। এ কারণে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আমি আমার কাজে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছি। আবার এমডি হিসেবে প্রতিষ্ঠানের সব সিদ্ধান্ত যে আমি নিই, তাও নয়। আমার প্রতিষ্ঠানের উপমহাব্যবস্থাপক, মহাব্যবস্থাপক পদে যাঁরা আছেন, তাঁরা নিজেরাই অনেক সিদ্ধান্ত নেন। আমার পর্যন্ত আসতেও হয় না। তবে আমরা অনিয়মের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে। এ জন্য আমাদের প্রতিষ্ঠানে হুইসিল ব্লোয়িং নামে একটি ব্যবস্থা চালু আছে। সেখানে যে কেউ যে কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ জানাতে পারে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগকারীকে পুরস্কৃত করারও ব্যবস্থা রয়েছে।