অর্জন অনেক, অবনতিও আছে

বড় দুটি মাইলফলক স্পর্শ করে আরেকটি অর্থবছর পার করেছে বাংলাদেশ। এর একটি হচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি প্রথমবারের মতো ৮ শতাংশ এবং রপ্তানি আয় ৪০ বিলিয়ন ডলার বা ৪ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া। পাশাপাশি প্রবাসী আয় বেড়েছে, বৈদেশিক বিনিয়োগে ছিল ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি থেকেছে স্থিতিশীল। এসব সূচকের উল্টো চিত্রও রয়েছে।

অর্থমন্ত্রী মূলত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের বিভিন্ন সূচক ধরেই। বাকিটা প্রাক্কলন। চূড়ান্ত তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায় আরও পরে। যেমন বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের চূড়ান্ত পরিসংখ্যান পাওয়া শুরু হয়েছে। আমদানিসহ দু-একটির তথ্য পেতে আরেকটু সময় লাগবে।

গত অর্থবছরের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু সূচকে আগের তুলনায় বরং অবনতি ঘটেছে। যেমন রপ্তানি আয় ভালো হলেও আমদানির চিত্র ভালো নয়। প্রবাসী আয় বেড়েছে, কিন্তু আমদানিতে প্রবৃদ্ধি কম। তারপরও কমানো গেলেও চলতি আয়ে ভারসাম্য আনা যায়নি। ঘাটতি আছে লেনদেনের সামগ্রিক ভারসাম্যেও।

তবে গত অর্থবছরের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল রাজস্ব আদায়, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যয়বহুল সঞ্চয়পত্রের ওপর অতি নির্ভরশীলতা, বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং আর্থিক খাতের দুর্বলতা। নতুন অর্থবছরে এসব দুর্বলতা কাটানোই হবে বড় চ্যালেঞ্জ। 

বিদায়ী অর্থবছরের অর্থনীতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি মূল্যায়ন আছে। ২১ জুলাই ব্যাংকের নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই মূল্যায়ন উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চাহিদার তেজিভাবের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রসারে গতিশীলতা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অব্যাহত ছিল। এটাই জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ১ শতাংশ অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি এবং সরকারের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়ন, ভোগ চাহিদা ও বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট আমদানি অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে জোরালো করেছে। এ ছাড়া রপ্তানি আয়ে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি বৈদেশিক চাহিদার ধারাও বজায় রেখেছে। আর জোগানের দিক থেকে বিশ্লেষণ হচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মূলত শিল্প খাত ও সেবা খাতের ক্রমবর্ধমান অবদানের প্রতিফলন।

>

বিদায়ী অর্থবছরের বিভিন্ন সূচকের চূড়ান্ত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে
এতে অর্জনের পাশাপাশি দুর্বলতাগুলোও প্রকাশ পাচ্ছে

বাংলাদেশ ব্যাংক আর সরকারের মূল্যায়ন মূলত একই ধারার। তবে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের বড় অংশই সরকারের এই বিশ্লেষণ নিয়ে সন্দিহান। গবেষণা সংস্থাগুলো আনুষ্ঠানিকভাবেই বলেছে, কয়েক বছর ধরে দেশের রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় দুটোরই গড় প্রবৃদ্ধি নিম্নগতি। উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে এই রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের সামঞ্জস্য পাওয়া যাচ্ছে না। আবার শিল্প খাতের উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গেও বেসরকারি বিনিয়োগের পরিসংখ্যানের মিল নেই। সুতরাং পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করাই হবে সামনের দিনগুলোতে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

সরকারের প্রকাশিত সূচক থেকে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ স্থবিরতা গত অর্থবছরেও বজায় ছিল। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যেও দেখা যাচ্ছে, ওই সময়ে বেসরকারি খাত ঋণও পেয়েছে কম, যা আগের অর্থবছরে ছিল ঋণাত্মক।

আমদানির চিত্রেও বেসরকারি বিনিয়োগের দুরবস্থার প্রমাণ মেলে। গত অর্থবছরে পুঁজি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলার হার আগের বছরের তুলনায় কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি। এমনকি এলসির নিষ্পন্ন হওয়ার হারও কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। শিল্পের কাঁচামাল আমদানির চিত্রও খুব ভালো নয়। গত অর্থবছরে এ জন্য এলসি খোলার হারের প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র দশমিক ২৭ শতাংশ এবং নিষ্পত্তির হার ৬ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বের অবসান ঘটানো হবে। ৩০ সাল হতে বাকি আছে ১১ বছর। এই হিসাবে প্রতিবছর ২৭ লাখ ২৭ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। যদিও প্রতিবছর শ্রমবাজারে প্রবেশ করে প্রায় ২০ লাখ মানুষ। সুতরাং বিপুল উচ্চাকাঙ্ক্ষার এই প্রতিশ্রুতি পালন করতে হলেও বেসরকারি বিনিয়োগের বিকল্প নেই।

নতুন অর্থবছরে অর্থনীতিতে বড় চাপ আসতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি থেকেও। চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ শেষ পর্যন্ত বিশ্বমন্দা ডেকে আনলে সামগ্রিক চাহিদা কমে যেতে পারে, আর তাতে বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। এর ফলে কমতে পারে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। এই দুইয়ের ওপর ভরসা করেই ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে বলে সরকারের দাবি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ রকম কিছু ঘটলে নিজেদের প্রস্তুত রাখাটাই হবে নতুন অর্থবছরের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।