দুধ নিয়ে দুশ্চিন্তা খামারিদের

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বড় খামারিদের একজন আবদুস সামাদ ফকির। তাঁর খামারে প্রায় ১৫০টি গরু রয়েছে। এখন দৈনিক ৫০০ লিটারের মতো দুধ পাওয়া যায়। পাস্তুরিত দুধের উৎপাদন ও বিপণন বন্ধের আদালতের নির্দেশটি শোনার পর তিনি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন, এখন কী হবে?

আবদুস সামাদ ফকির বলেন, বর্ষায় গরু বাথানে যেতে পারে না। সবুজ ঘাস পায় না। ফলে গরুগুলোকে দানাদার খাবার বেশি খাওয়াতে হয়। ৫০০ লিটার দুধ বেচে যে টাকা পাওয়া যায়, এখন তার পুরোটাই খাবারের পেছনে ব্যয় হয়। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো সংগ্রহ বন্ধ করলে বাজারে দুধের দাম অর্ধেকে নেমে আসবে। তখন গরুর খাবারের ব্যয়ের ৫০ শতাংশ অর্থ অন্য কোথাও থেকে জোগাড় করতে হবে।

দুধে অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসা পাওয়ার খবরে দুধ বিক্রি এমনিতেই কমেছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় গতকাল রোববার উচ্চ আদালত পাঁচ সপ্তাহের জন্য পাস্তুরিত তরল দুধ উৎপাদন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এরপর যোগাযোগ করা হলে দুই বড় কোম্পানি মিল্ক ভিটা ও প্রাণ ডেইরি বলেছে, তারা উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করবে। অন্যদিকে আড়ং বলেছে, তারা উচ্চ আদালতের নির্দেশ সংগ্রহ করার চেষ্টা করছে। সেটা দেখে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে। তিনটি কোম্পানিই বলেছে, পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন ও বিপণন বন্ধ করলে শুরুতেই তাদের খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ বন্ধ করতে হবে।

কোম্পানিগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বড়-ছোট মিলিয়ে প্রায় ১৪টি কোম্পানি এখন তরল দুধ সংগ্রহ করে। সরবরাহ ভালো থাকলে দৈনিক সাত-আট লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে কোম্পানিগুলো। ভরা মৌসুমে তা আরও বেড়ে যায়। হাইকোর্ট বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) লাইসেন্স পাওয়া ১৪টি প্রতিষ্ঠানের পাস্তুরিত দুধ উৎপাদনেই সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।

>

দুধে অ্যান্টিবায়োটিক ও সিসা পাওয়ার খবরে দুধ বিক্রি কমেছে
পাঁচ সপ্তাহের জন্য পাস্তুরিত তরল দুধ উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ হাইকোর্টের
দুধ সংগ্রহ করবে না কোম্পানিগুলো

দুধ সংগ্রহে শীর্ষ তিন প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি (মিল্ক ভিটা), প্রাণ ডেইরি ও আড়ং ব্র্যান্ডের তরল দুধ বাজারজাতকারী ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড এন্টারপ্রাইজ। এই তিন প্রতিষ্ঠান মিলে সাধারণ সময়ে দিনে পাঁচ লাখ লিটারের মতো দুধ সংগ্রহ করে।

মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখন দুধ সংগ্রহ বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কী করার আছে। আমাদের খামারিরা কী করবে, সেটাই চিন্তার বিষয়।’

একই ধরনের মন্তব্য করেন প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাস্তুরিত দুধ উৎপাদন বন্ধ থাকলে কোম্পানিগুলোর ক্ষতি হবে। তবে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে খামারিরা।’ তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় পরীক্ষা করে তাঁরা নিজেদের দুধে কিছু পাননি।

কোম্পানিগুলো যে দুধ সংগ্রহ করে, তার মূল কেন্দ্র পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চল। প্রতি লিটার দুধের দাম হিসেবে তারা চাষিদের দেয় ৩৬ থেকে ৪৫ টাকা। দাম নির্ভর করে দুধে ননির মাত্রার ওপর। ওই অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকটা দুধের ওপর নির্ভরশীল। ভারত থেকে গরু আসা কমে যাওয়ার পর অনেক তরুণ উদ্যোক্তা খামার করেছেন। গড়ে ৪০ টাকা ধরে ৮ লাখ লিটার দুধের দাম ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. ইমরান হোসেন প্রশ্ন করেন, ‘কোম্পানিগুলো না নিলেও গরু তো আর দুধ উৎপাদন বন্ধ রাখবে না। এই দুধ খামারিরা কী করবে? গরুর খাবারের দাম আসবে কোথা থেকে?’

ব্র্যাক ডেইরির পরিচালক মোহাম্মদ আনিসুর রহমান মনে করেন, সিসা বা অ্যান্টিবায়োটিক যদি থাকে, সেটার উৎস আগে খুঁজে বের করা উচিত। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো তো আর পয়সা খরচ করে সিসা বা অ্যান্টিবায়োটিক কিনে দুধে মেশাবে না। কারণ, এতে কোনো লাভ নেই। এর উৎস হতে পারে গরুর খাবার, ওষুধ, মাটি ও পানি। তাই উৎস কোথায়, সেটা বের করে সমাধানের সময় দেওয়া উচিত।

আনিসুর রহমান বলেন, এটা জাতীয় সমস্যা। সমাধানেও তাই জাতীয় উদ্যোগ দরকার।